
পূজার আগমনী বার্তা : শিউলির ঘ্রাণ, নাকি মূর্তি ভাঙার শব্দ?
HindusNews ডেস্ক :
গাজীপুর থেকে উঠতে থাকা মূর্তি ভাঙার খবরগুলো গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে দুর্গাপূজার এক বিরূপ 'আগমনী বার্তা' হয়ে উঠেছে। শৈশবের শিউলির ঘ্রাণ আর মহালয়ার বোধনের স্মৃতি যখন নিস্তব্ধ হয়ে আসে, তখনই শোরগোল করে সংবাদফিডে ছিটকে পড়ে মন্দির-প্রতিমার ওপর আক্রমণের খবর — যা কোনো কারণে দুর্গাপূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হয়ে উঠেছে বলে বহু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুভূত দুঃখ, অনাস্থা ও ভীতির জন্ম দিচ্ছে।
এই ধরনের হামলার চরিত্র এবং তা থেকে উদ্ভূত সামাজিক প্রতিক্রিয়া কেবল ব্যক্তিগত দুর্বৃত্ততা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় না—এগুলো কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক কারণে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উপর ধারাবাহিকভাবে চাপ প্রয়োগের লক্ষণ। মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনাগুলো প্রায়ই ঘটে লোকচক্ষুর অন্তরালে, বা প্রকাশ্যে করে এমনভাবে যে বিচারপ্রক্রিয়া প্রায়শই অদক্ষ অথবা অনুপস্থিত থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই হামলাকারীদের পরিচয় অজানা রাখা হয়, আবার ঘটনার সঙ্গে এলাকার পরিচিত কিছু মানুষও যুক্ত থাকে—শিক্ষকের ছাত্র থেকে শহরের মাস্তান, রাজনৈতিক কর্মী থেকে আশপাশের আড়ষ্ট লোক। ফলত আক্রান্ত সম্প্রদায়—বিশেষত হিন্দু—মানসিকভাবে ক্ষতগ্রস্ত হয় এবং রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আস্থা ধীরে ধীরে ক্ষীত হয়।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই প্রত্যক্ষ সহিংসতার বাইরে রয়েছে দু’ধরনের লুকানো সহিংসতা — কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক। কাঠামোগত সহিংসতা হলে তা আইন, প্রশাসন ও নীতি-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের সম্পদ, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় জমি-সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা বা অনিচ্ছুকতা। সাংস্কৃতিক সহিংসতা হলো এমন এক পরিশ্রমিত বিশ্বাসব্যবস্থা, যা গণমাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, রাজনৈতিক ভাষা ও সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে থেকে একটি গোষ্ঠীকে ঘৃণা-অবহেলার চোখে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরে এবং সহিংসতাকে 'স্বাভাবিক' বা 'ন্যায্য' বলে মেনে নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করে।
এই প্রেক্ষাপটে সমাজবিজ্ঞানীরা মাইনোরিটি স্ট্রেস থিওরির সাহায্য নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে সংখ্যালঘুদের উপর ধারাবাহিক মানসিক ও সামাজিক চাপ তাদের আত্মপরিচয়, অংশগ্রহণ ও সুস্থতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। লক্ষণগুলো—বহিঃস্থ হামলা, প্রতিবারের পূজার আগে প্রবল উদ্বেগ, জনসমাবেশে আত্মগোপনের প্রবণতা এবং নিজেকে হীন বা 'অন্য' ভাবা—সবই এই থিওরির আলোকে দৃশ্যমান হয়। ফলে শুধু একক ঘটনার ক্ষতি নয়, আরও বড় পরিসরে একটি সম্প্রদায় দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা এবং অধিকারহীনতার অনুভূতির শিকার হয়।
প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার ভুমিকা এখানে অত্যন্ত নির্ণায়ক। বারবার একই ধাঁচের হামলা, তদন্তের ঘাটতি ও দোষীদের লিখিত শাস্তি না পাওয়ার অভিজ্ঞতা কোনো সন্দেহ ছাড়াই আক্রান্ত সম্প্রদায়ের মনে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি জাগায়। অনেক সময় ইঙ্গিতমুলক আচরণ, অসম প্রক্রিয়া বা অমিমাংসিত অভিযোগ-প্রতিবেদনই সহিংসতাকে পুনরুৎপাদনে উৎসাহ দেয়। ফলে ক্ষমতার নীচের স্তরের মানুষগুলোই মোকাবিলায় এক ধরনের 'স্বল্পবলা' অবস্থায় পতিত হন—যেখানে তাদের আস্থা, নিরাপত্তা ও অধিকার তাকে পর্যায়ক্রমে শূন্যের দিকে ঠেলে দেয়।
কী করা উচিত? অনেকের কণ্ঠেই দীর্ঘকাল ধরে প্রয়োজনীয় দাবিগুলো উচ্চারিত হচ্ছে—কার্যকর তদন্ত, দ্রুত এবং স্বচ্ছ আইনি ব্যবস্থাপনা, ঘটনার রেকর্ড ও অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড। একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক স্তরে শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও সমাজিক ন্যারেটিভে সংখ্যালঘুদের অবদান ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। রাষ্ট্রের সরাসরি উদ্যোগ ও অঙ্গীকার ছাড়া এই ধাঁচের সহিংসতা বন্ধ করা কঠিন হবে—কারণ রাষ্ট্রের নির্বিকারতা বা অনীহা নিজেই সহিংসতার পুনরাবৃত্তিকে প্রজোঁষিত করে।
এ প্রসঙ্গে আলোচ্য প্রস্তাবটিও উঠে এসেছে, যা বিতর্কিত: কিছু লোক পরামর্শ দিয়েছেন—পূজা-উৎসবের রিচ্যুয়াল হিসেবে মূর্তি ভাঙাকে 'রিচ্যুয়ালাইজ' করে নিয়ন্ত্রণ করা, অর্থাৎ এটিকে কথাতীতভাবে উৎসবের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বাস্তব ভাঙচুরকারীদের উৎসাহ কমতে পারে। কিন্তু এই প্রস্তাবটি ন্যায্যতা ও নৈতিকতার দিক থেকে গভীর প্রশ্ন তোলে—কেন কোনো আঘাতকে ধর্মীয় আচারের আড়া দিয়ে বৈধতা দেওয়া হবে? আদৌ এটি সংখ্যালঘুদের গোপন ক্ষতি ও ট্রমা মুছতে পারে কি? অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন—যদি এমন 'রিচ্যুয়ালাইজেসন' বাস্তবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা সহিংসতাকে স্বাভাবিকীকরণ ও সাংস্কৃতিক অবমাননার আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার আশঙ্কা বহন করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার, প্রশাসন ও সমাজের শক্তিগুলো যদি সত্যিকারভাবে কাজ চালায়, তাহলে পূজা হবে উৎসবের নামেই; প্রতিমা হবে ভক্তির প্রতীক; আর কোনো সম্প্রদায় তার ধর্মীয় চিহ্ন বা স্থান নিয়ে অসহায়তার অনুভব করবে না। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার, আইন-শৃঙ্খলা কর্মে সত্যনিষ্ঠা, সামাজিক শিক্ষায় সহনশীলতার প্রচার ও গণমাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত প্রতিবেদন। না হলে শিউলির ঘ্রাণ হারিয়ে যাওয়াই কেবল নয়—দুর্গাপূজার আগমনী বার্তাও হয়ে উঠবে খবরের পাতায় ভাঙচুরের রংবেরঙের পুনরাবৃত্তি।