
হাতে টান পড়লেই হিন্দুপাড়ায় চাঁদা তুলতেন তাঁতী দল নেতা নবাব!
রাজশাহী প্রতিনিধি,HindusNews
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় সংখ্যালঘু হিন্দু পাড়ার বাসিন্দাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের অভিযোগে স্থানীয় তাঁতী দল নেতা নবাব হোসেন ওরফে বাচ্চুকে (৩০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় নারায়ণ ভবানী (৬০) নামে এক ব্যক্তিকে মারধরের পর ক্ষুব্ধ হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক নারী-পুরুষ থানায় গিয়ে বিক্ষোভ করেন। পরে রাতেই নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীনগর এলাকা থেকে নবাবকে গ্রেপ্তার করে বাগমারা থানা-পুলিশ। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
নবাব হোসেন উপজেলার গোবিন্দপাড়া ইউনিয়ন তাঁতী দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একই দিন তাঁতী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ ও সদস্যসচিব হাজি মজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে তাঁকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সংখ্যালঘুদের ওপর দীর্ঘদিনের চাঁদাবাজি
পুকুরের মাছ, হাঁস, কলার কাঁদি, ধান—যা পেতেন তাই জোর করে নিয়ে যেতেন নবাব। হিন্দুপাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত দুই বছর ধরে আওয়ামী সরকারের পতনের পর তিনি তাঁদের ‘আওয়ামী লীগার’ ট্যাগ দিয়ে ভয় দেখাতেন—“পাড়ায় থাকতে হলে টাকা দিতে হবে”। বাধ্য হয়ে প্রায় সবাই তাকে টাকা দিতেন। টাকা না দিলে নবাব হাঁসুয়া ও ছোট ছোরা দেখিয়ে ভয় দেখাতেন, এমনকি বয়স্ক মায়েদের কাছে গিয়েও ছেলেদের টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতেন।
গত সপ্তাহে নবাব নারায়ণ ভবানীর কাছে পাঁচ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মঙ্গলবার দুপুরে রাস্তায় ধরে নারায়ণকে মারধর করে ১৫ হাজার টাকা কেড়ে নেন বলে অভিযোগ। আহত নারায়ণ ভবানী বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।
থানা ঘেরাও ও বিক্ষোভ
মারধরের ঘটনাটি জানাজানি হলে চাঁইসাড়া গ্রামের প্রায় শতাধিক হিন্দু নারী-পুরুষ প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বাগমারা থানায় গিয়ে বিক্ষোভ ও থানা ঘেরাও করেন। তাঁরা নবাবের গ্রেপ্তার ও নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান। পুলিশ অভিযোগ নেওয়া, অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার এবং নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিলে বেলা আড়াইটার দিকে তাঁরা থানা চত্বর ত্যাগ করেন।
---
পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য
বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদুল ইসলাম HindusNews-কে বলেন, “আমরা অভিযোগ পেয়েই নবাবকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অনেক দিন ধরেই নবাব চাঁদা নিচ্ছিলেন। টাকা না পেলে মাছ, হাঁস ও মুরগি ধরে নিয়ে যেতেন। তবে তাঁরা আগে জানাননি। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।”
গোবিন্দাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হাবিবুর রহমান বলেন, “হিন্দুদের ওপর তার এত অত্যাচার শুরু হয়েছিল, তা বলার মতো না। মুসলমানদেরও যারা দুর্বল মানুষ, তারাও চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছিল। গতকাল আহত নারায়ণ ভবানীর সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি জানিয়েছেন নবাব ১৫ হাজার টাকা কেড়ে নিয়েছে। দলের নাম ভাঙিয়ে এভাবে চলতে পারে না।”
‘হাফ ম্যাড’ দাবি বিএনপির, তদন্ত কমিটি গঠন
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডি এম জিয়াউর রহমান নবাবকে “হাফ ম্যাড” বলে দাবি করেছেন। তাঁর ভাষ্য, “যখন যে দলের মিছিল হয়, নবাব সে দলের মিছিলেই যোগ দেয়। তাঁতী দলের কর্মিসভার দিন সে এসে সভাপতির পদ চেয়েছিল, পরে তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বানানো হয়। এখন বিতর্ক উঠলে দল দায় এড়াতে বহিষ্কার করেছে।”
তবে হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা বলেন, “জাতে মাতাল তালে ঠিক”—বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হলে নবাব কীভাবে রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে টাকা তোলেন? তাঁদের দাবি, নবাবের পেছনে কিছু প্রভাবশালী আছেন, যারা তাকে উসকে দিত।
তাঁতী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নবাবের কর্মকাণ্ড দলীয় সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তাই তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং তার সঙ্গে কোনো সাংগঠনিক সম্পর্ক না রাখতে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নবাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা যাচাই এবং ঘটনা উদ্ঘাটনের জন্য একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। এ টিমের রিপোর্টের ভিত্তিতে স্থায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আতঙ্কে হিন্দুপাড়া
নবাব গ্রেপ্তার হলেও আতঙ্ক রয়ে গেছে। হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা বলছেন, “দল থেকে বহিষ্কার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নবাবের পেছনের যারা আছেন, তারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আমরা চাই নিরাপত্তা ও স্থায়ী সমাধান।”