
নিহতের পরিবারের দাবি : কারখানার ষড়যন্ত্র ও অবহেলার কারণে দিপু দাসকে হত্যা !
নিজস্ব প্রতিবেদক :
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পোশাক কারখানার শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা ও পরবর্তী সময়ে মরদেহে আগুন দেওয়ার ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে নিহতের পরিবার। পরিবারটির দাবি, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও অবহেলার মধ্য দিয়েই দিপুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
নিহত দিপু চন্দ্র দাসের বোন চম্পা দাস HindusNews-কে বলেন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও কাজ সংক্রান্ত বিষয়ে দিপুর সঙ্গে কারখানার মালিকপক্ষ ও কিছু সহকর্মীর বিরোধ ছিল—এমন কথা পরিবার আগে থেকেই শুনে আসছিল। তাঁর অভিযোগ, সেই বিরোধ থেকেই দিপুর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়ে তাকে জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, দিপু শিক্ষিত মানুষ ছিলেন, ধর্ম সম্পর্কে তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল এবং তিনি কখনোই ধর্ম অবমাননাকর কোনো মন্তব্য করতে পারেন না। অভিযোগ ওঠার পর কারখানা কর্তৃপক্ষ চাইলে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে পারত; তা না করে জনতার সামনে ছেড়ে দেওয়াই তার মৃত্যুর পথ প্রশস্ত করেছে।
দিপু চন্দ্র দাস (২৭/২৮) ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার মোকামিয়া কান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে। গত দুই বছর ধরে তিনি ভালুকার জামিরদিয়া এলাকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড কারখানার লিংকিং সেকশনে কাজ করতেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সহকর্মীর সঙ্গে কথোপকথনের সময় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ ওঠে—এমন অভিযোগ ছড়িয়ে পড়লে কারখানা এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে বিক্ষুব্ধ লোকজন দিপুকে কারখানা থেকে টেনে বের করে নেয়। গণপিটুনিতে তার মৃত্যু হয় এবং পরে মরদেহে আগুন দেওয়া হয় বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে।
নিহতের বাবা রবি চন্দ্র দাস বলেন, দিপু ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনা শেষ করতে না পেরে তিনি গার্মেন্টসে চাকরি নেন। ধর্ম অবমাননার অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, দেশে আইন আছে—অভিযোগ থাকলে বিচার হতো। গরিব হওয়ার কারণে তারা ছেলের জীবন রক্ষা করতে পারেননি বলেও আক্ষেপ করেন তিনি। দিপুর মা শেফালী রানী দাস জানান, ছেলে নিজের চিকিৎসা বাদ দিয়ে পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতেন।
দিপুর স্ত্রী মেঘনা রানী দাস বলেন, তাদের একমাত্র সন্তান এখন বাবা-হারা। অভাবের সংসারে ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি দিশেহারা। রাষ্ট্রের কাছে তার একটাই দাবি—এই হত্যার সুষ্ঠু বিচার এবং দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
ঘটনার পর কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে কারখানার এক নিরাপত্তাকর্মী দাবি করেন, দিপুকে ক্ষমা চাইতে বলা হলেও তিনি তা করেননি; এরপর বিষয়টি ভেতরে-বাইরে জানাজানি হলে উত্তেজিত লোকজন গেটের সামনে জড়ো হয় এবং এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ তাকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়।
পুলিশ জানায়, ঘটনার পর ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কে কিছু সময় যান চলাচল ব্যাহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
ভালুকা মডেল থানায় নিহতের ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন। তদন্ত চলমান রয়েছে এবং পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ ঘটনায় সরকারিভাবে নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনও সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
নিহত দিপু চন্দ্র দাসের পরিবার একটাই দাবি জানিয়েছে—গুজব ও ষড়যন্ত্রের নামে কোনো নিরপরাধ মানুষের জীবন যেন আর না যায়, এবং এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত সত্য উদঘাটন করে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হোক।