দুর্গাপূজায় ‘বেশ্যাদ্বারের মাটি’ প্রসঙ্গে ভ্রান্তি ও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা

2 week ago
VIEWS: 310

ধর্মতত্ব ডেক্স:

দুর্গাপূজা নিয়ে সমাজে বহুদিন ধরেই একটি প্রচলিত ধারণা ঘুরে বেড়াচ্ছে মা দুর্গার প্রতিমা গড়তে এবং মায়ের মহাস্নানের জন্য নাকি পতিতালয়ের মাটি বা বেশ্যাদ্বারের মৃত্তিকা অপরিহার্য। এই কথাটি বহু মানুষের মনে কৌতূহল জাগালেও বাস্তবে এটি এক ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি।

শাস্ত্রসম্মত ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, এখানে ‘বেশ্যা’ বলতে বর্তমান সমাজের পতিতা বা বারবনিতাকে বোঝানো হয়নি, বরং তন্ত্রশাস্ত্রে একেবারেই ভিন্ন এক অর্থ নিহিত আছে।

কুলার্ণব তন্ত্র বলছে:

“ওঁ পূর্ণাভিষেকো দেবেশি দশ বিদ্যাবিধোস্মৃত।”

অর্থাৎ, দশ মহাবিদ্যার উপাসকরাই পূর্ণাভিষেকে অধিকারী, অন্য কেউ নন।

আবার মহানির্বাণ তন্ত্রে বলা হয়েছে:

“ওঁ অভিষিক্তা ভবেৎ বেশ্যা ন বেশ্যা কুলটা প্রিয়ে।”

এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, পূর্ণাভিষেক প্রাপ্তা নারীই ‘বেশ্যা’ নামে অভিহিত হন, তিনি কোনোভাবেই কুলটা বা পতিতা নন।

আসলে দীক্ষা, পুরশ্চরণ ও পূর্ণাভিষেকের মাধ্যমে যখন কোনো সাধিকা দেবত্বে উন্নত হন, তখন তাঁকেই তন্ত্রে ‘বেশ্যা’ বলা হয়েছে। তাঁদের অবস্থান করা স্থানকে বলা হয় ‘বেশ্যাদ্বার’, আর সেই দ্বারের মাটিকেই প্রতিমা নির্মাণের জন্য পবিত্র মনে করা হয়। অর্থাৎ, এই মাটি বর্তমান সমাজের পতিতালয় থেকে নেওয়া নয়, বরং দেবত্বপ্রাপ্ত সাধিকাদের অবস্থানস্থল থেকে প্রতীকীভাবে সংগৃহীত।

তন্ত্রশাস্ত্রে এমনও উল্লেখ আছে যে, কাঞ্চী, দ্বারাবতী, অবন্তি, মথুরা, অযোধ্যা, মায়াতীর্থ এবং দ্বারকা এই সাতটি স্থানকে ‘সপ্তবেশ্যা’ বলা হয়েছে। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, এখানে ‘বেশ্যা’ মানে কোনো কুলটা নারী নয়, বরং দেবত্বময় তীর্থস্থান।

তাই পতিতার ঘরের মাটি পূজায় লাগে এমন ব্যাখ্যা কেবল সংস্কৃত শব্দের ভুল বোঝাবুঝি থেকে তৈরি হয়েছে।

শাক্ততন্ত্রে আরও বলা হয়েছে, দুর্গাপূজায় নানা উৎস থেকে মৃত্তিকা সংগৃহীত হয়। যেমন সপ্তনদী ও সমুদ্রের মাটি, পঞ্চ প্রাণীর শিংয়ের মাটি, একাধিক শক্তিপীঠের মাটি ইত্যাদি।

আবার গুপ্তসাধনা তন্ত্রে ‘নবকন্যা’ ধারণা পাওয়া যায় নর্তকী, কাপালিকী, পতিতা, ধোপানী, নাপিতনী, ব্রাহ্মণী, শূদ্রাণী, গোয়ালিনী ও মালিনী। এই নবকন্যাদের প্রতীকস্বরূপ তাঁদের দ্বারের মাটিও প্রতিমা গড়ার অংশ হয়। এখানে পতিতার দ্বারের মাটি এককভাবে নয়, বরং আরও আট কন্যার দ্বারের মাটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত।

অন্যদিকে, প্রচলিত আছে,যখন কোনো পুরুষ পতিতার গৃহে গিয়ে অবৈধ কর্ম করে, তখন তাঁর জীবনের সমস্ত পূণ্য সেখানে বিলীন হয়ে যায়, আর তিনি বিপরীতে সব পাপ সঙ্গে নিয়ে আসেন। ফলে সেই স্থান পূণ্যময় হয়ে ওঠে। যদিও এই ব্যাখ্যা আংশিক এবং শাস্ত্রীয় ভিত্তি দুর্বল, তবে সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষকে অবৈধ যৌনাচার থেকে বিরত রাখার শিক্ষাই এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হয়তো ছিলো।

সবশেষে, আবার স্মৃতি-শাস্ত্র অনুযায়ী ‘বেশ্যমিত্রিকা’ মানে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু -পদ্মফুলের গোড়ার মৃত্তিকা, যা নদী বা জলাশয়ের ভাটা সময়ে সংগ্রহ করা হয়। এও একধরনের পবিত্র মাটি, যা উপাসনায় ব্যবহৃত হয়।

তাহলে মূলত স্পষ্ট হলো, দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণে ‘বেশ্যাদ্বারের মাটি’ বলতে পতিতালয়ের মাটি বোঝানো হয়নি। বরং এটি তন্ত্রশাস্ত্রের গভীর প্রতীকবাদের অংশ, যেখানে পূর্ণাভিষিক্তা দেবীস্বরূপ সাধিকা ও পবিত্র তীর্থস্থানের প্রতীকী মাটি গৃহীত হয়। মা দুর্গা যেহেতু সর্বনারীর প্রতীক, সর্বভূতে বিরাজমান শক্তির প্রতিরূপ, তাই প্রতিমা গড়ার মৃত্তিকা সংগ্রহের প্রক্রিয়াতেও এই সার্বজনীনতার প্রতিফলন ঘটেছে।

তাই মাটিকে পূজনীয় মাতৃরূপে (“পৃথিবীং মা হিংসী” ৪/১৩/১৮)সম্মান জানিয়ে, অপব্যাখ্যার অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে, আমাদের উচিত দুর্গাপূজার এই আচারকে তার আসল শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুসারে বোঝা ও মানা।

to join the global Sanatani Hindu Community
Connect with Sanatani Hindus from all over the world — share, learn, and grow together.
Explore Questions, Bhajan Lyrics, Leelas, Feeds, Business Pages, Products, plus Shlokas, Events, Courses, Jobs, Marriage, Help Posts, and more.
মন্তব্য করতে Login অথবা Registration করুন