
দীপ্তির হাতে দীপ্ত প্রতিমা : উত্তরবঙ্গের পূজামণ্ডপে নারী শিল্পীর নৈপুণ্যের ছাপ
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বৈদ্যেরবাজারের ছত্রজিত গ্রাম। জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামে দুর্গাপূজার আগে এখন ব্যস্ততার আরেক নাম—প্রতিমা নির্মাণ। ২০টিরও বেশি পরিবারে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ। দেশের অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও পুরুষ শিল্পীরাই সংখ্যায় বেশি। তবে এই ভিড়ের মধ্যেই নজর কাড়ছেন এক নারী—দীপ্তি রানী রায়।
প্রায় ২৪ বছর ধরে পুরুষ শিল্পীদের সঙ্গে সমানতালে প্রতিমা গড়ে চলেছেন তিনি। গত বছর ৯টি মণ্ডপে প্রতিমা পাঠিয়েছিলেন, আর এ বছর ১৩টি অর্ডার সম্পন্ন করেছেন। রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধাসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পূজামণ্ডপে পৌঁছে যাচ্ছে তাঁর গড়া প্রতিমা।
কৃষক পরিবারের বড় মেয়ে দীপ্তির স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। কিন্তু অভাব আর অল্প বয়সে বিয়ে সেই স্বপ্নে ছেদ টানে। চাষির মেয়ে হয়ে যান কুমোর বাড়ির বউ। ছোটবেলা থেকে প্রতিমা গড়ার কাজ দেখতে দেখতে বেড়ে উঠলেও হাতে-কলমে শেখার সুযোগ পাননি বিয়ের আগে। শ্বশুরবাড়িতে এসে স্বামী বিপুলকান্তি রায়ের কাছেই শেখেন প্রতিমা গড়ার সূক্ষ্ম কৌশল।
সংসার সামলাতে সামলাতে দক্ষ কারিগরে পরিণত হন দীপ্তি। তাঁর নিপুণ হাতে প্রতিমা পায় জীবন্ত রূপ। তিনি শুধু জীবিকার জন্য নয়, ভালোবাসা ও ভক্তির টানে প্রতিমা তৈরি করেন। নিজেই বললেন, “চেষ্টা করি কাজগুলো নিখুঁতভাবে করতে, যাতে সবার ভালো লাগে।”
প্রতিমা বানানোর উপকরণ—এঁটেল মাটি, বাঁশ, খড়, পাট—সবকিছুরই দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। তবু মনের টানে থেমে নেই দীপ্তি। সাধারণত একেকটি প্রতিমা তৈরি করতে ২০ দিন লাগে। আকার, নকশা ও মানভেদে দাম হয় ১৭ থেকে ২৫ হাজার টাকা। কুড়িগ্রামের ‘গর্বের দোলা’ বিল থেকে প্রতিমা তৈরির মাটি কিনে আনতে হয় তাঁকে। গত বছর এক ট্রলি মাটির দাম ছিল ১২০০ টাকা, আর এবার দিতে হয়েছে ৬০০০ টাকা।
দীপ্তির জীবন-জীবিকা এখন প্রতিমানির্ভর। ছেলে কলেজে পড়ে, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন প্রতিমা বিক্রির টাকায়। সংসারে নিত্যদিনের খরচ, ছেলের লেখাপড়া, চিকিৎসা—সবই চলে এই আয়ে।
তাঁর কাছে দুর্গাপূজা অন্যরকম। বললেন, “সব পূজা একদিকে, দুর্গাপূজা আরেকদিকে। যত সুন্দর করে মাকে গড়তে পারি, মনে হয় দেবী আমাকে তত বেশি আশীর্বাদ দেবেন।” তবে নিজের বাড়িতে দুর্গাপূজা হয় না, তিনি জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেন মনোবাসনা পূরণের জন্য।
দীপ্তির চোখে সবচেয়ে কষ্টের দিন বিজয়া দশমী। প্রতিমা বিসর্জনের সময় মনে হয়, “প্রতিমা নয়, ভালো হতো যদি সংসারের দুঃখগুলো বিসর্জন দিতে পারতাম!”
৪৪ বছর বয়সী এই নারী শিল্পী জানালেন, যত দিন বাঁচবেন প্রতিমা গড়ার কাজ চালিয়ে যাবেন। প্রতিমায় তুলির আঁচড় দিতে দিতেই তিনি বলেন, “এই মাটি, এই রঙের গন্ধই জানিয়ে দেয় আমি মা। গড়ার দায়িত্ব তো আমাদের—মেয়েদের, মায়েদের।”