

পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ স্মরণে উঠছে স্মৃতিস্তম্ভ: এক যুগ পর জবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানবিক উদ্যোগ
পুরান ঢাকার সেই রক্তাক্ত ইতিহাস আবারও ফিরে এসেছে আলোচনায়— ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধ চলাকালে বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল দর্জি বিশ্বজিৎ দাসকে। এক যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তার হত্যার বিচার এখনও শেষ হয়নি। তবে এবার সেই বিশ্বজিতের স্মৃতি ধরে রাখতে উদ্যোগ নিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
তারা পুরান ঢাকার সদরঘাট-শাঁখারীবাজার চার রাস্তার মোড়টিকে ‘বিশ্বজিৎ চত্বর’ হিসেবে নামকরণের প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সেখানে একটি স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই মধ্যে প্রাথমিকভাবে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আবেদনও পাঠানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রইস উদ্দিন জানান, বিশ্বজিতের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগের ফ্যাসিবাদী হামলায় হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যার নৃশংসতা যেন ভুলে না যায়, নতুন প্রজন্ম যেন জানে কীভাবে অন্যায়ের শিকার হয়েছিল এক নিরীহ তরুণ, সে কারণেই আমরা এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান বলেন, “বিশ্বজিৎ নিহত হওয়ার এত বছর পরও বিচার হয়নি, এটা খুবই দুঃখজনক। কিন্তু ‘বিশ্বজিৎ চত্বর’ আর এই স্মৃতিস্তম্ভ তাঁর ত্যাগ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে থাকবে।” আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা চাই রাষ্ট্র দ্রুত এই মামলার বিচার শেষ করুক। বিশ্বজিতের স্মৃতিস্তম্ভ হবে ন্যায়বিচারের প্রতি নতুন প্রজন্মের বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।”
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে বড় ভাইয়ের সঙ্গে দর্জির কাজ করতেন বিশ্বজিৎ দাস। তাঁর গ্রামের বাড়ি ছিল শরীয়তপুরে। সেদিন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধ চলাকালে তিনি বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একদল কর্মী তাঁকে বিরোধী দলের কর্মী ভেবে আক্রমণ করে। প্রকাশ্য রাস্তায় নির্মমভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে।
ঘটনার পর সূত্রাপুর থানার এসআই জালাল আহমেদ অজ্ঞাত ২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর আদালত আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে; চারজনের মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবনে রূপান্তরিত হয় এবং দুজন খালাস পান। যাবজ্জীবন পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে আরও দুজন পরে খালাস পেয়েছেন। মামলাটি বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
বিশ্বজিতের বড় ভাই উত্তম দাস বলেন, “ভাইকে হারিয়ে এক যুগ পার হয়ে গেছে। এখনও তার বিচার শেষ হয়নি। তবে শুনে ভালো লাগছে যে, তার স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ হচ্ছে। এতে নতুন প্রজন্ম জানবে যে, কীভাবে আমার ভাইকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল।” বিশ্বজিতের বাবা অনন্ত দাস বলেন, “ছেলেকে হারিয়েছি অনেক আগে। এত বছর পর তার স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ হচ্ছে শুনে মনে শান্তি পেয়েছি।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, তিনি এখনো চিঠি হাতে পাননি, তবে পেলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।