

ভয়াল কোজাগরী পূর্ণিমা: নোয়াখালীতে পাঁচ সহস্রাধিক হিন্দু হত্যা দিবস
HindusNews ডেস্ক :
আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন। কিন্তু এই দিনটি বাঙালি হিন্দু সমাজের ইতিহাসে চিরকাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে—কারণ ১৯৪৬ সালের এই দিনেই, ১০ অক্টোবরের কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে, গুজব ছড়িয়ে নোয়াখালিতে সংঘটিত হয়েছিল ভয়াবহ হিন্দু গণহত্যা। প্রায় ২০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সংগঠিত হয় এক সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ, যেখানে পাঁচ সহস্রাধিক হিন্দু নরনারীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, হাজার হাজার নারী ও কিশোরীকে ধর্ষণ ও অপহরণ করা হয়, এবং লক্ষাধিক হিন্দুকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।
১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর ছিল কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন—যে রাতে হিন্দু গৃহস্থের ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি ও ঘণ্টাধ্বনি ওঠার কথা ছিল, সেদিন নোয়াখালির আকাশজুড়ে ছিল শুধু হাহাকার, কান্না আর আগুনের লেলিহান শিখা। স্থানীয় মুসলিম জনতা "আল্লাহু আকবার" ধ্বনি তুলে হিন্দু পল্লীগুলোয় ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নারী লুণ্ঠনে মেতে ওঠে। যেটিকে অনেক ইতিহাসবিদ “নোয়াখালি দাঙ্গা” নামে আখ্যা দিয়েছেন, সেটি প্রকৃত অর্থে ছিল একতরফা হিন্দু নিধনযজ্ঞ—যার ভয়াবহতা মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
গুজবের সূত্রপাত ঘটে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানার করপাড়া গ্রামে, যেখানে গুজব ছড়ানো হয় যে এক সন্ন্যাসী, ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাধু ত্রিয়াম্বাকানন্দ, ছাগল বলির পরিবর্তে মুসলমানের রক্ত দেবীকে নিবেদন করবেন। যদিও এর কোনো প্রমাণ কখনোই পাওয়া যায়নি, এই গুজবকেই অস্ত্র বানিয়ে মুসলিম লীগ নেতা গোলাম সরোয়ার হুসেইনীর নেতৃত্বে ‘মিঞার ফৌজ’ নামক এক জেহাদি বাহিনী হিন্দুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই রাতেই শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ—বাড়ি বাড়ি অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যা, ধর্মান্তর, এবং অসংখ্য হিন্দু গ্রামকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
রাজেন্দ্রলাল চৌধুরী, নোয়াখালির হিন্দু মহাসভার সভাপতি, নিজের পরিবারসহ এই আক্রমণের শিকার হন। তাঁর ছেলে গোপাল বসুকে বল্লম দিয়ে হত্যা করা হয়, রাজেন্দ্রলালকে অকথ্য নির্যাতন শেষে মুণ্ডচ্ছেদ করে তাঁর মাথা ফুটবলের মতো লাথি মারা হয়। তাঁর স্ত্রী বাণীরানি চৌধুরী পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দিকে লেখা এক চিঠিতে লিখেছিলেন—
“আমার কুমারী কন্যা নমিতা রায় চৌধুরীকে দুর্বৃত্তরা আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। তারা যে উচ্ছৃঙ্খলতার পরিচয় দিয়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।”
দাঙ্গার সময় হাজার হাজার হিন্দু পরিবার পালিয়ে যায় কুমিল্লা, চাঁদপুর, আগরতলা ও অন্যান্য এলাকায়। প্রায় ৫০,০০০ থেকে ৭৫,000 শরণার্থীকে অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হয়। যারা রয়ে গিয়েছিল, তাদের প্রতিদিন "জিজিয়া" নামে কর দিতে হতো স্থানীয় মুসলিম নেতাদের, নিজেদের রক্ষার জন্য। মুসলিম মৌলবিরা হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইসলামি শিক্ষা নিতে বাধ্য করত, পুরুষদের টেনে নিয়ে গিয়ে নামাজ পড়ানো হতো, জোর করে গোমাংস খাওয়ানো হতো। অনেক নারীকে বলপূর্বক মুসলিমদের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়, আর ধর্মান্তরিত হিন্দুদের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আরবি নামে।
নোয়াখালির জমিদারবাড়ি, স্কুল, দোকান—সব ধ্বংস করে দেওয়া হয়। গোপাইবাগ, দালালবাজার, নন্দীগ্রাম, রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, ছাগলনাইয়া—প্রতিটি জায়গায় একই চিত্র। চিত্ত দত্তরায় নিজের স্ত্রী-সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন যাতে তারা জেহাদিদের হাতে না পড়ে। নারায়ণপুরের জমিদার সরেন্দ্রনাথ বসুকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। গোপাইবাগের দাস পরিবারের পুরুষদের হত্যা করে আগুনে ফেলা হয়, নারীদের ওপর চলে অকথ্য পাশবিকতা।
বঙ্গীয় আইন সভার একমাত্র হিন্দু প্রতিনিধি হারান চন্দ্র ঘোষ চৌধুরী বলেছিলেন, “এটি কোনো দাঙ্গা নয়, এটি সংখ্যাগুরু মুসলমানদের সংগঠিত আক্রমণ।” শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও স্পষ্ট বলেন, “নোয়াখালির ঘটনা কোনো সাধারণ দাঙ্গা নয়, এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত গণহত্যা।”
১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে মহাত্মা গান্ধী স্বয়ং নোয়াখালিতে আসেন। করপাড়া ও লামচর গ্রামে গিয়ে তিনি দেখেন শুকনো রক্ত, পোড়া ঘর, এবং কবরস্থ দেহাবশেষ। এক জায়গায় ২১ জন নারী-পুরুষের কঙ্কাল উদ্ধার করে প্রার্থনা সভা হয়। গান্ধীজী নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন, আর তার চোখে ঝরে অশ্রু।
নোয়াখালির এই হত্যাযজ্ঞে আনুমানিক ৫,০০০ হিন্দু নিহত হন, হাজার হাজার নারী ধর্ষিতা হন, এবং এক লক্ষাধিক মানুষ জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত হন। অনেকে গরুর মাংস খেতে বাধ্য হয়ে, নিজের ধর্মীয় পরিচয় হারিয়ে জীবিত থেকেও মৃত হয়ে যান।
এই ভয়াবহ ঘটনাটি কেবল ইতিহাস নয়, এক চিরস্থায়ী শিক্ষা—গুজব, ঘৃণা আর ধর্মীয় উন্মাদনা কীভাবে একটি সভ্য সমাজকে অমানবিকতার অতল গহ্বরে ফেলে দিতে পারে। আজও ডিজিটাল যুগে একই ধরনের গুজব ছড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন জ্বালানো হয়, ফেসবুকে শুরু হয় মিথ্যা অপবাদের ঝড়। ইতিহাসের বিচার না হওয়ায় সেই পুরোনো কৌশলই আজ আরও আধুনিক রূপে ফিরে এসেছে।