
ভারত থেকে ভেসে আসা গাছের গুঁড়ি বিক্রি হচ্ছে ‘চন্দন কাঠ’ নামে! কুড়িগ্রামে হুলস্থুল
HindusNews ডেস্ক :
ভারত থেকে ভেসে আসা অচেনা গাছের গুঁড়ি নিয়ে এখন সরগরম কুড়িগ্রামের বিভিন্ন এলাকা। ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে জেলার কালজানি ও দুধকুমার নদীর পানির প্রবাহ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় রবিবার ভোর থেকে নদীতে দেখা যায় হাজার হাজার ভাসমান কাঠের গুঁড়ি। দেখতে লালচে রঙের ও বাকল-শিকড়বিহীন এসব কাঠকে স্থানীয়রা ‘রক্ত চন্দন’ ভেবে দলে দলে নদীর তীরে ভিড় করছেন। কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কাঠ টেনে তীরে তুলছেন, আর সেগুলো বিক্রি করছেন “চন্দন কাঠ” নামে।
দুপুরের পর থেকেই এলাকাজুড়ে শুরু হয় কাঠ কেনাবেচা। কেউ কেউ ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকাচ্ছেন এক একটি গুঁড়ির জন্য। আবার কারও কারও দাবি, এই কাঠের বাজারমূল্য লাখ টাকারও বেশি। স্থানীয়রা বলছেন, কিছু গুঁড়ি এত বড় ও ভারী যে, একাধিক মানুষ মিলে তা টেনে তুলতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে দামাল গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মোতালেব জানিয়েছেন, তিনি চারজনের সহায়তায় ৫০ ফিট দৈর্ঘ্যের একটি লাল কাঠ উঠিয়েছেন, এবং সেটির দাম ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেতে পারেন বলে আশা করছেন।
তবে এই ঘটনাই বিপদের কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবিবার সকালে কালজানি নদী থেকে কাঠ উঠাতে গিয়ে মনছুর আলী (৪০) নামের এক ব্যক্তি পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয়েছেন। ঘটনাটি এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, কাঠ ধরতে গিয়ে এমন ঝুঁকি না নিতে জনগণকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
বামনডাঙ্গা তেলিয়ানীর স্কুলশিক্ষক ওছমান গণি জানান, শনিবার গভীর রাতে গ্রামের মানুষ হঠাৎ হৈচৈ শুরু করলে তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন চোর পড়েছে। কিন্তু বাইরে গিয়ে দেখেন, পুরো দুধকুমার নদীর তীরে শত শত মানুষ আলো হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছে, কেউ আবার সাঁতরে গাছ টেনে আনছে। রাতভর নদীর দুই পাড়ে গাছের স্তূপ জমে যায়, যা সকাল নাগাদ বাজারে বিক্রির জন্য সাজানো হয়।
এদিকে স্থানীয় উৎসুক জনতা ধারণা করছেন, ভেসে আসা এসব কাঠের জ্বালানি হিসেবে বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। অনেকে সেগুলো ছোট টুকরো করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য, আবার কেউ মণ হিসেবে বিক্রি করছেন বাজারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কাঠ আদতে চন্দন নয়। কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও উদ্ভিদবিদ মীর্জা নাসির উদ্দিন বলেন, “সার কাঠে ট্যানিন ও ফেনলিক যৌগ থাকে। কাঠ যখন দীর্ঘ সময় পানিতে ডুবে থাকে, তখন এই যৌগগুলো পানিতে মিশে অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে লালচে-বাদামি রঙ ধারণ করে। ফলে কাঠ দেখতে রক্ত চন্দনের মতো লাগে, কিন্তু বাস্তবে এটি চন্দন নয়।”
জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাদিকুর রহমানও একই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা সরেজমিনে গিয়ে কাঠগুলো পরীক্ষা করেছি। দীর্ঘ সময় পানিতে থাকার কারণে এগুলোর রঙ বদলে গেছে। এগুলোর সঙ্গে শ্বেত বা রক্ত চন্দনের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ না বুঝেই এগুলো চন্দন ভেবে বিক্রি করছে।”
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিব্বির আহমেদ জানিয়েছেন, “উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে প্রচুর গাছের গুঁড়ি ভেসে আসছে। এগুলো ধরতে গিয়ে অনেকে পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে, যা প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি করছে। কাঠের সঙ্গে সাপসহ অন্যান্য প্রাণীর উপস্থিতিও দেখা গেছে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।”
স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এ ঘটনায় এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও উত্তেজনা বিরাজ করছে। কেউ ভাবছেন এটি প্রকৃত রক্ত চন্দন, কেউ আবার সরকার কাঠগুলো জব্দ করবে এই আশঙ্কায় তাড়াহুড়া করে বিক্রির চেষ্টা করছেন।
কুড়িগ্রামের নদীগুলোর পাড়জুড়ে এখনো স্তূপ হয়ে পড়ে আছে শত শত গাছের গুঁড়ি। নদীর ঢলে ভেসে আসা এই অচেনা কাঠগুলো ঘিরে স্থানীয়দের কৌতূহল, লোভ আর ভয়— সব মিলিয়ে এক অভিনব দৃশ্য তৈরি হয়েছে সীমান্তঘেঁষা এই জেলায়।