
“সব হিন্দু ইসকন নয়” — সামাজিক বিভ্রান্তি নিরসনে হিন্দু সমাজের জোর আহ্বান
নিজস্ব প্রতিবেদক:
সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে “ইসকন” বা “ISKCON” (International Society for Krishna Consciousness) নিয়ে ব্যাপক ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে দেশের সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ও অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় ইসকনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পুরো হিন্দু সম্প্রদায়কে জড়িয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা চালানো হচ্ছে— যা হিন্দু সমাজের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
🔶 ইসকন আসলে কারা?
ইসকন হলো এক আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সংগঠন, যা প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালে। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্তি প্রচার, মানবকল্যাণ এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনকে উৎসাহিত করা।
ইসকন সদস্যদের জন্য কিছু কঠোর নিয়ম ও নীতি বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করতে হয়—
১️⃣ নিরামিষ জীবনযাপন: মাছ, মাংস, ডিমসহ সকল আমিষ খাবার পরিহার করে সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী থাকা।
২️⃣ নেশামুক্ত জীবন: মদ, ধূমপান, গাঁজা, তামাক বা যে কোনো প্রকার নেশাজাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকা।
৩️⃣ ব্রহ্মচার্য ও সংযম: বিবাহ না করা এবং যৌন সম্পর্ক থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা।
৪️⃣ জুয়া পরিহার: সকল প্রকার জুয়া ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
৫️⃣ মানবকল্যাণে নিবেদন: লালসা, রাগ, হিংসা ত্যাগ করে মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা।
এই কঠোর জীবনবিধি সাধারণ হিন্দুদের পক্ষে পালন করা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। তাই হিন্দু সমাজের বিশাল অংশ ইসকনের অনুসারী নয়।
🔶 দেশে ইসকনের পরিধি সীমিত
ধর্মীয় বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে ইসকন ভক্তের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি নয়। অথচ দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ২.৫ কোটি। তবুও সাম্প্রতিক সময়ে ইসকনের কিছু সদস্যের কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সমগ্র হিন্দু সমাজকে দোষারোপের প্রবণতা দেখা দিয়েছে, যা এক ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচেষ্টা বলে মনে করছেন অনেকেই।
🔶 আতঙ্কে সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায়
বিভিন্ন স্থানে ইসকনকে ঘিরে চলা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও গুজবের কারণে সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। অনেক পরিবার আশঙ্কা করছে, এই পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে তবে তারা নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে। কেউ কেউ এমনকি দেশ ত্যাগের চিন্তাও করছেন বলে জানা গেছে।
একজন হিন্দু সমাজকর্মী বলেন,
“দেশে যত হিন্দু আছেন, তাঁদের বেশিরভাগই সাধারণ পরিবারভিত্তিক মানুষ। তাঁরা ইসকনের মতো কঠোর সন্ন্যাসজীবন অনুসরণ করেন না। কিন্তু এখন এমনভাবে প্রচার চলছে যেন সব হিন্দুই ইসকনের অংশ— এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর।”
🔶 সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান
হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে, “৫ আগস্টের ঘটনার পর যেমন মুসলমান ভাইয়েরা হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, এবারও সাধারণ হিন্দুদের পাশে দাঁড়াতে হবে।”
তাঁদের আশঙ্কা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আবারও হিন্দু সম্প্রদায়কে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা হতে পারে। তাই সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে সচেতন থেকে একে অপরের পাশে থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
একজন ধর্মীয় বিশ্লেষক বলেন,
“ইসকন একটি ধর্মীয় সংগঠন, পুরো হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই কিছু ঘটনার দায় সমগ্র হিন্দু সমাজের ওপর চাপানো অত্যন্ত অনুচিত ও বিপজ্জনক।”
বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে —
“সব হিন্দু ইসকন নয়। ইসকন একটি আধ্যাত্মিক সংগঠন, কিন্তু বাংলাদেশে কোটি কোটি সাধারণ হিন্দু পরিবারভিত্তিক ও সামাজিকভাবে ধর্ম পালন করেন। গুজব, ঘৃণা ও ভুল তথ্য বন্ধ হোক। দেশ থাকুক শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যে।”