
এবার ইসলামপন্থীদের আপত্তির মুখে সংগীত শিক্ষক পদ বাতিল
HindusNews ডেস্ক :
হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলের আপত্তির মুখে অবশেষে পিছু হটল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন করে সৃষ্ট সংগীত শিক্ষক ও শরীরচর্চা শিক্ষকের পদ বাতিল করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত সংশোধিত গেজেট রোববার (২ নভেম্বর) জারি করা হয়েছে।
গত আগস্টে “সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা–২০২৫” জারি করে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শরীরচর্চা বিষয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের পদ সৃষ্টি করে। সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ, কারণ এটি প্রাথমিক স্তরে শিশুদের মানসিক বিকাশ, সৃজনশীলতা ও শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত ছিল। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই ইসলামপন্থী দলগুলো এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা শুরু করে।
তাদের অভিযোগ ছিল, সংগীত শিক্ষা ইসলামবিরোধী এবং এটি “ধর্মীয় মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ণ” করে। তারা সরকারের কাছে সংগীত শিক্ষকের পরিবর্তে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানায়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে জামায়াতে ইসলামীসহ পাঁচটি ইসলামি দলের নেতারা অভিযোগ করেন, সরকার শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা ও আদর্শিক গঠন না করে বরং “গানের শিক্ষক” দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করছে। তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সংগীত শিক্ষকের পদ বাতিল না হলে “ইসলামপ্রেমী জনগণ রাজপথে নামতে বাধ্য হবে।”
এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে সর্বদলীয় ইসলামী শিক্ষা রক্ষা জাতীয় কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার দাবি জানায়। সেখানে জামায়াতে ইসলামী নেতা অধ্যাপক মুজিবুর রহমান সরকারকে কড়া ভাষায় সতর্ক করে বলেন, সংগীত শিক্ষকের পদ যদি বাতিল না করা হয়, তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর আন্দোলনে নামবে তারা। হেফাজতে ইসলামও একই দাবি জানায় এবং সরকারকে “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করার” আহ্বান জানায়।
এসব ধারাবাহিক চাপ ও হুমকির পর অবশেষে সরকার পিছু হটে। রোববার প্রকাশিত গেজেটে সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষকের পদ বাতিলের ঘোষণা দিয়ে বিধিমালা সংশোধন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিন্দু নিউজ–কে জানান, “ধর্মীয় সংবেদনশীলতা ও সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।”
তবে শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীরা এই সিদ্ধান্তে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, “সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষা শুধু বিনোদনের বিষয় নয়, এটি শিশুদের মানসিক ভারসাম্য ও মানবিক মূল্যবোধ গঠনে সহায়তা করে। সরকার যদি ধর্মীয় চাপের মুখে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এটি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ভয়াবহ নজির স্থাপন করবে।”
সংস্কৃতিবিদরা বলছেন, “বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। সেই রাষ্ট্রে সংগীত শিক্ষক বাতিল করা আসলে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার পরাজয়।”
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ইসলামপন্থীরা সরকারের পদক্ষেপকে ‘ধর্ম রক্ষার বিজয়’ বলে অভিহিত করছে, অন্যদিকে সংস্কৃতিচিন্তকরা একে ‘অন্ধকারে ফেরার পদক্ষেপ’ বলে সমালোচনা করছেন। অনেকে মন্তব্য করছেন, “সংগীত শিক্ষার জায়গায় ধর্মীয় শিক্ষক চাই—এ দাবি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মান এবং মুক্তচিন্তার পরিপন্থী।”
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সংগীত শিক্ষা শুধু একটি বিষয় নয়, এটি মুক্তচেতনা, মানবিকতা ও সংস্কৃতির প্রতীক। ইসলামপন্থী চাপে সংগীত শিক্ষা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে এক উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত, যা কেবল একটি পদ বাতিল নয়—বরং একটি প্রজন্মের মানসিক বিকাশের পথ সংকুচিত করার ইঙ্গিত বহন করছে।
সূত্র : Dhaka Mail