
রাস কী ?রাসলীলার নামে পুরুষ-মহিলার নৃত্যকীর্তনের যৌক্তিকতা কি ?
"রাস" শব্দটি এসেছে "রস" থেকে, যার অর্থ আনন্দ বা দিব্য অনুভূতি। হিন্দু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, রাস হল জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন, যা ভক্তির গভীরতা এবং ঈশ্বরের প্রতি নিঃশর্ত প্রেমের এক আধ্যাত্মিক প্রতীক।
রাস কী?
মূলত, রাসলীলা হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং বৃন্দাবনের গোপীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক ঐশ্বরিক ও অপ্রাকৃত নৃত্যলীলা, যা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, বিশেষ করে ভাগবত পুরাণ এবং গীত গোবিন্দে বর্ণিত আছে। এই লীলা শারদ পূর্ণিমা বা কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে সংঘটিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।
এর আক্ষরিক অর্থ এক ব্যক্তি (নট) কর্তৃক বহু ব্যক্তির (নটী) সাথে নৃত্য করা হলেও, বৈষ্ণবীয় দর্শনে এর গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে:
জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন: গোপীরা এখানে জীবাত্মার প্রতীক এবং শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমাত্মা। রাসলীলা হলো জাগতিক কামনা-বাসনা ত্যাগ করে পরমেশ্বরের সাথে আত্মার মহামিলন।
কাম থেকে প্রেমে রূপান্তর: এই লীলা দৈহিক কাম বা বাসনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যখন কামদেব (প্রেমের দেবতা) রাস মণ্ডলে দৈহিক কামনা ছড়াতে চেয়েছিলেন, তখন ভগবান তাকে দমন করেছিলেন।
বিশুদ্ধ ভক্তি: এটি ভক্তের নিঃশর্ত ভক্তির প্রকাশ, যেখানে ভক্ত কোনো প্রতিদানের আশা না করে কেবল ভগবানের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে।
পুরুষ-মহিলার নৃত্যকীর্তনের যৌক্তিকতা
রাসলীলার নামে পুরুষ ও মহিলাদের সম্মিলিত নৃত্য বা কীর্তন মূলত সেই ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক লীলার অনুকরণ বা স্মরণ। এর যৌক্তিকতা নিম্নরূপ:
ধর্মীয় উৎসব ও আরাধনা: এই নৃত্য-কীর্তন হলো বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় অনুষ্ঠিত একটি ধর্মীয় উৎসবের অংশ। এর মাধ্যমে ভক্তরা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাদের ভক্তি ও প্রেম নিবেদন করেন।
আধ্যাত্মিক ভাব: প্রকৃত বৈষ্ণবীয় শাস্ত্রে এই নৃত্যকে সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, যেখানে জাগতিক সুখের অনুভূতিকে আধ্যাত্মিকতায় এবং কামপ্রবৃত্তিকে নিষ্কাম প্রেমে রূপান্তর করা হয়েছে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য: ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, মণিপুর, এবং বৃন্দাবনে, এই উৎসব একটি বড় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে পালিত হয়। মণিপুরী নৃত্যশৈলী এর একটি ধ্রুপদী উদাহরণ।
যদি এই নৃত্য-কীর্তনগুলি শাস্ত্রীয় ভাবধারা মেনে এবং পবিত্রতার সাথে করা হয়, তবে তা ধর্মীয়ভাবে যৌক্তিক। তবে, যদি একে নিছক কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার উপলক্ষ হিসেবে দেখা হয় (যেমনটি অনেক সময় আধুনিক উপস্থাপনায় ভুলভাবে দেখানো হয়), তবে তা এর মূল আধ্যাত্মিক তাৎপর্য থেকে বিচ্যুত হয়। প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ভক্তির মাধ্যমে জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করা।