
হিন্দু ভোটব্যাংকে নজর জামায়াতের? সংখ্যালঘুদের দিকে ইসলামপন্থী দলের নতুন কৌশল
HindusNews ডেস্ক :
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সংখ্যালঘু ভোট এখন নতুনভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই ভোটব্যাংক ঘিরে এবার আলোচনায় এসেছে ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে জামায়াতের সভা, সমাবেশ এবং এমনকি ‘সনাতনী কমিটি’ গঠনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, ইসলামপন্থী এই দলটি এখন প্রকাশ্যেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝে কাজ শুরু করেছে।
ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার উমেদপুর বাজারে সম্প্রতি এমন একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলের দিকে বাজারের পাশে খোলা জায়গায় বসানো হয় কয়েকটি বেঞ্চ। সেখানে গোল হয়ে বসেছিলেন প্রায় ডজনখানেক সনাতন ধর্মাবলম্বী স্থানীয় মানুষ। তাঁদের মাঝে জামায়াতের একজন স্থানীয় নেতা লিফলেট বিতরণ করছিলেন। তাঁর নাম মো. শওকত আলী, উমেদপুর ইউনিয়ন জামায়াতের আমির। তিনি বলেন, কয়েক মাস ধরে তাঁরা সনাতন ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁর দাবি, “যারা সভায় এসেছেন, সবাই এখন জামায়াতের সমর্থক, দাঁড়িপাল্লার সমর্থক।”
স্থানীয় এই জামায়াত নেতা আরও বলেন, তাঁরা প্রতিবেশীদের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার বার্তা দিতে চান। তাঁর ভাষায়, “তারা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করবে, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের কর্তব্য। আমাদের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক—তারা সবসময় ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার পাবে।”
অন্যদিকে স্থানীয় হিন্দুদের একাংশ জানিয়েছেন, গত ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। সেই সময় জামায়াত নেতারা তাঁদের কাছে এসে আশ্বাস দেন যে, বিপদে তাঁদের পাশে দাঁড়াবেন, নিরাপত্তা দেবেন। স্থানীয় এক সনাতন ধর্মাবলম্বী বলেন, “ওরা এসে বলে, বিপদে পড়লে ফোন দিতে, পাশে থাকবে। এই সাপোর্ট তো অন্যরা দেয়নি, তাই আমরা তাদের সাপোর্ট দিচ্ছি।”
এমনই ঘটনা শুধু ঝিনাইদহ নয়, দেশের অন্যান্য জেলাতেও দেখা যাচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে খুলনার ডুমুরিয়ায় জামায়াতে ইসলামী একটি বড় ‘হিন্দু সম্মেলন’ আয়োজন করে। সেখানে শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই অংশ নেন। সম্মেলনের মঞ্চে জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে ‘দাঁড়িপাল্লা প্রতীক’-এর প্রচারণাও চালানো হয়। জানা গেছে, এখন জামায়াতের বিভিন্ন জেলায় ‘সনাতনী কমিটি’ গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেখানে স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী সমর্থকদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, তাঁদের গঠনতন্ত্রেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রয়েছে। তাঁর ভাষায়, “অমুসলিমদের আমরা সদস্য করতে পারি। শুধু শর্ত হলো—জামায়াতের শৃঙ্খলা মেনে চলা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অংশ নেওয়া এবং অবৈধভাবে উপার্জন না করা। মুসলমান সদস্যদের মতো ধর্মীয় শর্ত এখানে নেই।” তিনি আরও বলেন, “তারা তাদের কমিউনিটির নেতা হতে পারেন, তবে মূল জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসার সুযোগ আমাদের বিধি অনুযায়ী নেই।”
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ, যা অনেক সংসদীয় আসনে ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর সংখ্যালঘু ভোট কোন দিকে যাবে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামপন্থী দল হিসেবে জামায়াত ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘু ভোটারদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হলেও এখন তাদের ভোট আকৃষ্ট করতেই এই নতুন কৌশল নিয়েছে। খুলনার হিন্দু সম্মেলন কিংবা জেলা পর্যায়ে ‘সনাতনী কমিটি’ গঠন—সবই সেই নির্বাচনী কৌশলের অংশ বলে অনেকে মনে করছেন।
তবে জামায়াত নেতারা বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন। মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “আমরা তাদের ভোটব্যাংক হিসেবে দেখি না। তারা নাগরিক, ভোটার—আমরা কেবল তাদের পাশে থাকতে চাই, তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়তে চাই।”
অন্যদিকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ এই উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। তিনি বলেন, “ধর্মভিত্তিক একটি দলে অন্য ধর্মের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা বাস্তবে কোনো পরিবর্তন আনবে না। এটা মূলত ভোট বাড়ানোর কৌশল। কারণ দায়িত্বপূর্ণ পদ না দিলে এই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হবে না।” তাঁর মতে, জামায়াত কিংবা অনুরূপ দলগুলো যদি সত্যিই সংখ্যালঘুদের পাশে থাকতে চায়, তাহলে তাদের প্রথমে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে সোচ্চার হতে হবে। শুধু ভোটের সময় বন্ধুত্ব দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের সমমর্যাদা বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ভোট সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ইসলামপন্থী একটি দলের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি হঠাৎ এই আগ্রহকে অনেকেই নির্বাচনী কৌশল হিসেবেই দেখছেন। অন্যদিকে জামায়াত বলছে—তারা ধর্ম নয়, নাগরিকত্বের ভিত্তিতে সবাইকে পাশে চায়। তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, যে দলের আদর্শ ধর্মভিত্তিক, সেখানে সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্তি আদৌ কতটা স্থায়ী এবং বাস্তবসম্মত হবে?