
জ্যোতি থেকে খালেদা, খালেদা থেকে পাগলী: হিন্দু জ্যোতি রানীর জীবন আজ এক করুণ সতর্কবার্তা
HindusNews ডেস্ক :
এক সময়ের প্রাণবন্ত, শিক্ষিতা ও সংস্কৃতিমনা হিন্দু কন্যা জ্যোতি রানীর জীবন আজ সমাজের কাছে এক মর্মস্পর্শী শিক্ষা। ক্লাস টেনে পড়াকালীন সময়ে খালিদ হাসান নামের এক যুবকের সাথে তার পরিচয় হয়। শুরু হয় বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম। জ্যোতির পরিবার আপত্তি জানালেও, কৈশোরের আবেগ ও অজ্ঞতার বশে সে পরিবারের কথা উপেক্ষা করে খালিদের প্রেমে অন্ধ হয়ে পড়ে। সময়ের ব্যবধানে খালিদ তার প্রেমিকাকে বোঝায়, “তুমি যদি আমাকে সত্যি ভালোবাসো, তাহলে আমার ধর্ম গ্রহণ করো।”
অবশেষে কলেজে পড়াকালীন সময়েই জ্যোতি ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করে খালিদ হাসানকে। নতুন নাম হয় তার “মোছাঃ খালেদা বেগম”। পরিবার, ধর্ম, সংস্কৃতি—সব কিছু ত্যাগ করে ভালোবাসার নামে এক নতুন জীবনে প্রবেশ করে সে। কিন্তু সেই ভালোবাসার গল্প বেশিদিন টেকে না।
বিয়ের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই দুই পরিবারের মধ্যে শুরু হয় ঝড়। সামাজিক কলঙ্ক ও পারিবারিক প্রতিশোধের ভয়ে তারা শহরে ভাড়া বাসায় চলে যায়। খালিদ রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করে, আর জ্যোতি—অর্থাৎ খালেদা—পরিণত হয় এক গৃহবন্দি স্ত্রীর জীবনে। হঠাৎ একদিন দুর্ঘটনায় আহত হয় খালিদ। হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় তার শেষ কথা ছিল—“আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়, তুমি শুধু আমার ধর্মটা আগলে রেখো।” সেই বাক্য যেন তার আসল উদ্দেশ্যের চূড়ান্ত প্রকাশ—ভালোবাসা ছিল না, বরং জ্যোতিকে নিজের ধর্মে টেনে আনা ছিল মূল লক্ষ্য।
খালিদের মৃত্যুর পর জ্যোতির জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। সমাজ তাকে আজ “খেলনা পাগলী” নামে ডাকে। এক সময়কার হাসিখুশি, কবিতা লেখা, গান গাওয়া মেয়েটি এখন রাস্তার পাশে বসে অস্পষ্টভাবে শুধু “খ… খ…” বলে বিড়বিড় করে। তার চোখে আর কোনো আলো নেই—রয়েছে শুধু হাহাকার আর এক অজানা শূন্যতা।
এই করুণ পরিণতি কি নিছক একটি দুর্ঘটনা? নাকি এটি এমন এক কর্মফল, যা নিজের ধর্ম, পরিবার ও সংস্কৃতি ত্যাগের ফল? যারা প্রেমের নামে ধর্মান্তর ঘটায়, তারা আদৌ কি ভালোবাসে? যদি খালিদ সত্যিই জ্যোতিকে ভালোবাসত, তাহলে কেন ধর্মান্তরই ছিল তার ভালোবাসার শর্ত? কেন জ্যোতির নাম, পরিচয় ও বিশ্বাস পরিবর্তনের প্রয়োজন হলো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই সমাজের গভীর সংকটকে প্রকাশ করে—ভালোবাসার মুখোশের আড়ালে চলছে এক সাংগঠনিক ধর্মীয় জিহাদ, যার লক্ষ্য সনাতনী নারীদের পরিচয়, বিশ্বাস ও সমাজ কাঠামোকে দুর্বল করা।
আজ বাংলাদেশের অনেক হিন্দু পরিবার আধুনিক শিক্ষায় গুরুত্ব দিলেও ধর্মীয় শিক্ষাকে প্রায় উপেক্ষা করে। এই অজ্ঞতা ও উদাসীনতার সুযোগ নিচ্ছে জিহাদি চক্র। তারা জানে, যে তরুণী নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ, তাকে সহজেই প্রভাবিত করা যায়। বন্ধুত্ব, সহানুভূতি বা প্রেমের মাধ্যমে তাদের টেনে নেওয়া হয় ধর্মান্তরের ফাঁদে, যেখানে এক সময়ের স্বাধীনচেতা মেয়েরা পরিণত হয় এক অনুগত ছায়ায়।
জ্যোতির গল্প কেবল একটি নারীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; এটি পুরো সমাজের প্রতিচ্ছবি। যখন পরিবার সন্তানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ শেখাতে ব্যর্থ হয়, তখন তাদের মন সহজেই দুর্বল হয়ে পড়ে। যে মেয়ে নিজের ধর্ম, ইতিহাস ও সংস্কৃতি জানে না, সে একদিন নিজের পরিচয়ও হারায়। এই অজ্ঞতার পরিণতিই হলো আজকের “খেলনা পাগলী” জ্যোতি রানীর মর্মান্তিক জীবন।
ধর্মগ্রন্থে বলা আছে—যে মানুষ নিজের শিকড় ভুলে যায়, সে ধ্বংস অনিবার্য। বেদ, উপনিষদ ও গীতা শুধু ধর্মের বই নয়; এগুলো আত্মচেতনা, জ্ঞান ও মানবতার আলো। এই জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন হলেই অন্ধকার গ্রাস করে। তাই প্রয়োজন আত্মপরিচয়ের শিক্ষা, আত্মরক্ষার মানসিকতা ও ধর্মচেতনার জাগরণ।
সমাজের প্রতিটি পরিবারকে এখনই সচেতন হতে হবে। সন্তানদের শুধু একাডেমিক শিক্ষা নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা দিতে হবে। মেয়েদের আত্মসম্মান ও আত্মরক্ষার চেতনায় গড়ে তুলতে হবে। কারণ, এই সমাজে “প্রেমের ছলে প্রতারণা” এখন শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি এক সামাজিক রোগ—যার প্রতিকার শুধুমাত্র সচেতনতা ও আত্মপরিচয়ের মধ্য দিয়েই সম্ভব।
জ্যোতি রানীর জীবন তাই এক আয়না। যে আয়নায় প্রতিটি সনাতনী পরিবার নিজেদের প্রতিফলন দেখতে পারে। যতদিন হিন্দু সমাজ নিজের ধর্মীয় পরিচয়ে গর্ব করতে ভুলে যাবে, যতদিন আত্মরক্ষা ও ধর্মচেতনা অবহেলিত থাকবে—ততদিন নতুন নতুন জ্যোতি জন্ম নেবে, আর নতুন নতুন “মায়াবিনি” হারিয়ে যাবে সময়ের অন্ধকারে।
এই গল্প কেবল এক নারীর নয়, এটি এক জাতির জন্য কঠিন সতর্কবার্তা। ভালোবাসার নামে ধর্মত্যাগ কোনো মুক্তি নয়, এটি আত্মবিনাশের পথ। সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্র—সবাইকে এখন এই বার্তাটি বুঝতে হবে। না হলে “জ্যোতি” নামটি আরও বহুবার লেখা হবে, প্রতিবার নতুন এক ট্র্যাজেডির সূচনা হিসেবে।