


ঢাকায় অনুষ্ঠিত 'হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন': মতুয়া সম্প্রদায়ের ঐক্যের ডাক ও সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ঢাকা প্রতিনিধি, HindusNews :
রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) কনভেনশন হলে আজ অনুষ্ঠিত হলো বহুল প্রত্যাশিত “হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন–২০২৫”। মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্য জোটের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আগত হাজারো হিন্দু প্রতিনিধি, সমাজকর্মী, ধর্মীয় সংগঠক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অংশগ্রহণ করেন। দিনব্যাপী এই আয়োজনটি হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রশ্নে এক ঐতিহাসিক সংলাপের মঞ্চে পরিণত হয়।
সকাল ১০টায় পবিত্র বেদমন্ত্র ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠের মাধ্যমে সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। প্রজ্বলিত হয় ঐক্যের প্রদীপ, আর সনাতন ভজনের সুরে পুরো কনভেনশন হল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ধর্মীয় আবেগ ও ঐক্যের অনুরণন। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন মতুয়া বহুজন সমাজ ঐক্য জোটের আহ্বায়ক শ্রী সোমনাথ সেন। তাঁর সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক সমেন সাহা, সদস্যসচিব ও মুখপাত্র কপিল কৃষ্ণ মণ্ডল, বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক এবং বিশিষ্ট সনাতনী নারী নেত্রী সুবর্ণা চৌধুরীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিনিধি নেতৃবৃন্দ।
সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ কারও দলীয় স্বার্থ বাস্তবায়ন নয়; বরং জনগণের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন সময়ের দাবি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় এই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানবতার ধারাবাহিকতার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই তাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও।
সম্মেলনে বক্তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা, ভূমি দখল বন্ধ, মন্দির ও ধর্মীয় স্থাপনার সুরক্ষা, এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সংখ্যালঘু কোটা পুনর্বহালের দাবি জানান। বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতন, ভূমি দখল, মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটছে; অথচ এর যথাযথ প্রতিকার মিলছে না। তিনি সরকারের পাশাপাশি সকল রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানান সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও ন্যায্য অধিকার রক্ষায় দৃঢ় অবস্থান নিতে।
মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি তাপস দাস অধিকারী বলেন, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মতুয়া সম্প্রদায় সমাজে মানবতা, সহাবস্থান ও সত্যধর্মের বার্তা প্রচার করে এসেছে। অথচ আজও তারা বৈষম্য, অবহেলা ও ভয়-নির্যাতনের শিকার। এখন সময় এসেছে নিজেদের মধ্যে ঐক্য সুসংহত করে সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে নতুন করে গড়ে তোলার।
দুপুরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধি বক্তারা স্থানীয় সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, মন্দিরে হামলা, জমি দখল ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরের মতো ঘটনাগুলো শুধু সংখ্যালঘু নয়, গোটা জাতির মানবিক চেতনার ওপর আঘাত। এই বাস্তবতায় একটি জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের দাবি জোরালোভাবে উঠে আসে।
সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে সভাপতির ভাষণে সোমনাথ সেন বলেন, “আমরা কোনো দলের বিরোধী নই; আমরা কেবল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মর্যাদা রক্ষা মানেই বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষা।” তিনি আরও যোগ করেন, “এই দেশ যেমন আমাদের, তেমনি দায়িত্বও আমাদের। আমাদের ঐক্যই হোক অন্যায়ের জবাব।”
সম্মেলনের শেষে গীতা পাঠ, শান্তিপাঠ ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। অংশগ্রহণকারীরা প্রতিজ্ঞা করেন, ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় হিন্দু প্রতিনিধি কাউন্সিল গঠন করে সমাজের প্রতিটি স্তরে সংগঠিত ভূমিকা রাখবেন।
দিনব্যাপী এই হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন শুধু মতুয়া সমাজ নয়, সমগ্র সনাতন সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা ও ঐক্যের সঞ্চার করেছে। অনেকে একে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবেও দেখছেন।