
হিন্দুরা নয়, বরং উচ্চবর্গের মুসলমানরাই বিরোধিতা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা!
HindusNews ডেস্ক :
সম্প্রতি এনসিপি নেতা জনাব নাহিদ ইসলাম দাবি করেছেন যে, উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য, দলিল ও সমসাময়িক সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল এবং ইতিহাস বিকৃতির স্পষ্ট উদাহরণ। বাস্তব ইতিহাস বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা এসেছিল মূলত আশরাফ বা উচ্চবর্গীয় মুসলমান সমাজের মধ্য থেকেই। বিশেষ করে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়পন্থী মুসলমান নেতারা এই প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন নানা অজুহাতে। অপরদিকে, উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই এই বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে শিক্ষক, পরামর্শক, দাতা এবং সংগঠক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ছিল হিন্দু জমিদার ও দানশীল ব্যক্তিদের দানকৃত জমি ও অর্থে গঠিত, এবং এই শিক্ষাব্যবস্থার ভিতও মূলত হিন্দু সমাজই রচনা করেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা এসেছিল মূলত তিন শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে, এবং তাদের কারণ ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবিত্ত মুসলমানেরা মনে করতেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে তাতে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কোনো লাভ হবে না, বরং উপকৃত হবে পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা। তাই তারা চাইতেন বিশ্ববিদ্যালয় হোক আলীগড়ে, যা হবে সর্বভারতীয় মুসলিমদের কেন্দ্র। ‘দি মুসলিম’ পত্রিকার ১৯১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদনে চব্বিশ পরগণার মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন স্পষ্ট ভাষায় জানায় যে, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হবে এবং তা হবে শিক্ষাগতভাবে পক্ষপাতদুষ্ট একটি উদ্যোগ।
আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা কিন্তু অনেক আগে থেকেই ছিল। ১৮৯৮ সালে স্যার সৈয়দ আহমেদের হাত ধরে যে আলীগড় আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তা পরে পুরোপুরি মুসলমানদের জন্য সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মৌলবী রফিউদ্দিন আহমদ তাঁর এক প্রবন্ধে লেখেন, “আলীগড় হবে আধুনিক, বিশ্বমানের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কিন্তু এটি হবে কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য, বিশেষত সমাজের উচ্চবিত্ত মুসলমানদের জন্য।” অর্থাৎ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনায় সাধারণ মুসলমান কিংবা অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্থান ছিল না। এটি ছিল উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মুসলমানদের শিক্ষাকেন্দ্র, যেখানে পড়াশোনা হবে ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে।
গবেষক গেইল মিনো এবং ডেভিড লেলিভেলড তাদের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন যে, মৌলানা মুহাম্মদ আলী ‘দি কমরেড’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি সেখানে বলেন, পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং আলীগড়ে প্রস্তাবিত সর্বভারতীয় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ই বেশি যুক্তিসঙ্গত। প্রয়োজনে ঢাকায় একটি কলেজ হতে পারে, তবে সেটি থাকতে হবে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। এমনকি মৌলানা আকরম খাঁ-ও এ বিষয়ে সতর্কতা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মতে, সরকার যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে, তবে সাধারণ মুসলমানদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য আর কোনো অর্থ বরাদ্দ থাকবে না। ব্যারিস্টার আবদুর রসুল এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মুসলমানদের জন্য “বিলাসিতা” বলে আখ্যা দেন। তাঁর মতে, কয়েকজন ভাগ্যবান শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় সুযোগ না দিয়ে বরং সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে অর্থ ব্যয় করা উচিত। দি মুসলমান পত্রিকা এ-ও লিখেছিল, “যেহেতু প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে অসাম্প্রদায়িক, তাই এর মাধ্যমে মুসলমান সমাজের বিশেষ কোনো লাভ হবে না।” তারা যুক্তি দিয়েছিল যে, বরং দরিদ্র ও যোগ্য মুসলমান ছাত্রদের জন্য বৃত্তি এবং কিছু উৎকৃষ্ট মানের কলেজ স্থাপন করলে শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব হবে।
এমনকি পূর্ববঙ্গের কিছু উচ্চবিত্ত মুসলমানও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের শিক্ষার হার এতটাই কম যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তাদের কোনো বাস্তব উপকারে আসবে না। তাদের মধ্যে তখন মাত্র দশ হাজারে একজন স্কুল পর্যায় পাস করত। তাই তারা ভাবতেন, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় নয়, প্রয়োজন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার বিস্তার। তারা এটাও মনে করতেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় হলে মুসলমানদের জন্য যে সরকার নির্ধারিত শিক্ষা বাজেট আছে তা এক জায়গায় ব্যয় হয়ে যাবে, ফলে নতুন কোনো স্কুল বা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এই আশঙ্কাতেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু নেতা ও শিক্ষাবিদও প্রথমদিকে আপত্তি জানান, কিন্তু সেটি ছিল সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে। তারা মনে করতেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট কমে যাবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই যুক্তিতেই আপত্তি তোলেন। তবে পরবর্তীতে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অতিরিক্ত চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা হবে। এর বিনিময়ে স্যার আশুতোষ তাঁর আপত্তি প্রত্যাহার করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বড় অংশ তিনি নিজেই পাঠান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন হিন্দু এবং তাদের অনেকে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রেরিত। হিন্দু সমাজের শিক্ষানুরাগ, দানশীলতা ও মানবিক উদ্যোগেই বিশ্ববিদ্যালয়টির বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল। এরা কেউ কাজ করেননি ধর্মীয় পরিচয়ে, বরং শিক্ষার অগ্রগতির জন্য মানবতার মানসে। বিপরীতে, যারা এর বিরোধিতা করেছিলেন, তারা তা করেছিলেন নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক স্বার্থ রক্ষার্থে, ধর্মীয় বিদ্বেষে নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস তাই স্পষ্ট করে জানায়, এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম কোনো সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের ফসল নয়, বরং অর্থনৈতিক, প্রাদেশিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের সংঘাতের ফলাফল। কিন্তু এর পেছনে হিন্দু সমাজের অবদান ছিল অগ্রগণ্য— শিক্ষক, জমিদার, দাতা ও শিক্ষানুরাগী সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে এই উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র।