
আজ দেবসেনাপতি কার্ত্তিক পুজো :পুরাণ, আচার ও লোকবিশ্বাসে এক ঐতিহ্যের দিন
বিশেষ প্রতিবেদন :
আজ কার্তিক সংক্রান্তি। বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হচ্ছে দেবসেনাপতি কার্ত্তিকের পুজো— একাধারে ঘরোয়া পূজা, আবার বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বজনীন আয়োজন। কাটোয়া, বাঁশবেড়িয়া, সোনামুখী ও চুঁচুড়ার কার্ত্তিকপুজোতে আজ উপচে পড়ছে ভক্তসংখ্যা। বছরের এই দিনে বাংলার পরিবারগুলোতে ভক্তিভরে কার্ত্তিক ও দেবসেনার আরাধনা করা হয়।
কার্ত্তিকের জন্মের গল্প বহু পুরাণে ছড়ানো। কোথাও তিনি মহাদেবের পুত্র, কোথাও অগ্নিদেবের, আবার কোথাও কৃত্তিকাদের দ্বারা লালিত। কালিদাসের কুমারসম্ভব কাহিনিটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে, তবে আজকের পূজার সঙ্গে সর্বাধিক সম্পর্কিত কাহিনি পাওয়া যায় মহাভারতের বনপর্বে— যেখানে কার্ত্তিকের ‘দেবসেনাপতি’ হয়ে ওঠার ইতিহাস স্পষ্টভাবে উঠে আসে।
মহাভারতের বিবরণ অনুযায়ী, ব্রহ্মার মানসকন্যা দেবসেনাকে অপহরণ করে দৈত্য কেশী। পরে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে উদ্ধার করলে দেবসেনা ইন্দ্রের কাছে এমন এক বর চান— যিনি দেব, দানব, যক্ষ সহ সমগ্র সৃষ্টির ওপর বিজয়ী হবেন। ঠিক সেই সময় অমাবস্যা তিথিতে ঋষিদের যজ্ঞের মধ্য দিয়ে জন্ম নেন কার্ত্তিক। লক্ষণীয়, এই জন্মকথায় মহাদেবের উল্লেখ নেই। জন্মের মাত্র ষষ্ঠদিনেই ব্রহ্মার তত্ত্বাবধানে দেবসেনার সঙ্গে কার্ত্তিকের বিবাহ সম্পন্ন হয়। ভারতীয় পৌরাণিক সাহিত্যে এটিই অন্যতম কম বয়সে সংঘটিত বিবাহ হিসেবেই বিবেচিত।
এই দেবসেনাই পরবর্তীতে রূপ নেন মা ষষ্ঠীতে— বাংলার লোকধর্মে যিনি শিশুদের রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে পূজিত। কার্ত্তিকের ছয় মাথা, জন্মের ষষ্ঠ দিনে বিবাহ, এবং ষষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক— সব মিলিয়ে ‘ছয়’ সংখ্যাটি কার্ত্তিক পূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস পাওয়া যায়— কার্ত্তিকের কিছু অনুচর নাকি শিশুদের ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত ক্ষতি করতে পারে। তাই তাঁদের তুষ্ট করার বিধান দিয়েছেন কার্ত্তিক নিজেই, সঙ্গে আছেন দেবসেনা। এই কারণেই লোকায়ত উপাসনায় দেবসেনা বা ষষ্ঠী দেবীকে কার্ত্তিকের সঙ্গে সর্বদা দেখা যায়। সময়ের সাথে দেবসেনার প্রকৃত পরিচয় আড়ালে চলে যায়, আর ছড়িয়ে পড়ে কার্ত্তিকের “চিরকুমার” থাকা সংক্রান্ত ভুল ধারণা।
তবে পুরাণ নিজেই জানায়— কার্ত্তিক সন্তানপ্রদানকারী দেবতা, আর দেবসেনা সন্তানলালনের প্রতীক। অর্থাৎ সন্তান আগমন থেকে লালনপালন— সবকিছুতেই পিতা-মাতার যৌথ দায়িত্ব ও মানসিক প্রস্তুতির গুরুত্ব তুলে ধরে এই পৌরাণিক জুটি। এ কারণে আজকের দিনে বহু ভক্তই মনে করিয়ে দেন— কার্ত্তিক পুজো কখনোই শুধু “পুত্রসন্তান লাভের” জন্য নয়, বরং সব সন্তানের কল্যাণ ও পরিবারের সমৃদ্ধির প্রতীক।
কার্তিক সংক্রান্তির এই শুভক্ষণ তাই শুধু ধর্মীয় আচার নয়— সমাজকে দেয় সমতা, দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার বার্তা। পুত্র বা কন্যা— উভয়েই সমানভাবে পরিবারের আলো জ্বালাতে পারে। দম্পতির সম্মতি, প্রস্তুতি ও মানসিক শান্তিই নতুন জীবনের আগমনের পথ নির্ধারণ করে।
সন্তান জন্ম নাও নিতে পারে— তাতে পথ বন্ধ হয় না। পৃথিবীর কোনো এক কোণে অপেক্ষা করে থাকে এমন শিশু, যে আগলে নিতে চায় পিতামাতার ভালোবাসা। সেই পথও সমান স্নেহময়, সমান পবিত্র।
আজকের দেবসেনাপতি কার্ত্তিক পুজো তাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়— ভক্তি শুধু আচার নয়, এক গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রকাশ।