
ব্লাড ক্যান্সার জয় করে বিসিএস ক্যাডার – অসম্ভবকে সম্ভব করলেন প্রিয়াংকা রায়
HindusNews ডেস্ক :
জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিপক্ষও প্রিয়াংকা রায়কে থামাতে পারেনি। বরং সেই প্রতিপক্ষই তাকে আরও দৃঢ়, আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। ব্লাড ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধির সঙ্গে লড়ে টিকে থাকা এবং তারপর ফিরে এসে বিসিএসের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া—এ যেন এক অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্প। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা রায় আজ বাংলাদেশের তরুণ সমাজের অনুপ্রেরণার নাম।
শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই প্রিয়াংকা ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্রী। ফার্মেসি বিভাগে একাধিক সেমিস্টারে ৪.০০—সম্পূর্ণ সিজিপিএ অর্জন করে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন সেরাদের সেরা হিসেবে। একটাই স্বপ্ন ছিল—বাবাকে গর্বিত করা। তিনি চাইতেন পৃথিবী একদিন বলুক, ‘ওই যে প্রিয়াংকার বাবা।’ সেই স্বপ্নকে হৃদয়ে ধরে যখন তিনি এগিয়ে চলছিলেন, তখনই জীবনে নেমে আসে সবচেয়ে বড় ঝড়।
২০১৯ সালের ৩ জুলাই চিকিৎসকের মুখে শোনা যায় কঠিন এক নাম—একিউট লিউকেমিয়া, অর্থাৎ ব্লাড ক্যান্সার। সেই মুহূর্তে যেন থেমে যায় পুরো পরিবার। শুরু হয় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার এক অসীম কঠিন পথযাত্রা।
চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে। সাধারণ স্কুলশিক্ষক বাবার পক্ষে এই চিকিৎসার ব্যয় বহন করা ছিল প্রায় অসম্ভব, তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য জীবনের সবটুকু শক্তি দিয়ে লড়ে গেছেন। সেই সময়ে সহপাঠী ও শিক্ষকদের অকৃত্রিম সহযোগিতা প্রিয়াংকার জন্য ছিল বিরাট শক্তি। চার মাসের ভয়াবহ চিকিৎসা, কষ্টকর কেমোথেরাপি, দুঃসহ ব্যথা—সবকিছুই প্রিয়াংকা মোকাবিলা করেছেন অবিশ্বাস্য সাহস নিয়ে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন তিনি মৃত্যুকে একদম সামনে থেকে দেখছিলেন, তখনই যেন তিনি শিখে ফেলেছিলেন জীবনের নতুন অর্থ—বেঁচে থাকা মানেই নতুন করে শুরু করা।
চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে যখন আবার পড়াশোনা শুরু করলেন, তখন স্টাডি গ্যাপের কারণে তিনি বুঝতে পারলেন, অনেক প্রাপ্য সম্মান আর অর্জন থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। আর ঠিক এই বঞ্চনাই তাকে নতুন উদ্যম দিল। তিনি ঠিক করলেন, এবার তাকে যেকোনো মূল্যে সেরা হতে হবে। কোনো কোচিংয়ের সাহায্য ছাড়াই তিনি নিজেই বানালেন পড়ার রুটিন, গড়ে তুললেন নিজের পরিকল্পনা আর নিজের ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখে শুরু করলেন বিসিএসের প্রস্তুতি। প্রতিটি ধাপ—প্রিলিমিনারি, লিখিত—তিনি পার করলেন নিজের মেধা, অধ্যবসায় ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে। এ সময়েই তিনি সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে নিয়োগের সুযোগ পান এবং চাকরির পাশাপাশি বিসিএসের প্রস্তুতি চালিয়ে যান।
অবশেষে আসে সেই প্রতীক্ষিত দিন। গতকাল ৪৫তম বিসিএসের ফল প্রকাশিত হতেই প্রিয়াংকা রায় নির্বাক হয়ে যান। ব্লাড ক্যান্সার থেকে বেঁচে ফিরে আসা একটি মেয়ের জীবনে ক্যাডার হওয়া যেন আরেকটি অলৌকিক উপহার। তাঁর পরিবার, যারা শুধুই চেয়েছিল তিনি বেঁচে থাকুন, তারাই আজ আনন্দে উচ্ছ্বসিত। প্রিয়াংকা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “ক্যান্সার থেকে বেঁচে ফিরেই বিশ্বাস হয়েছিল, আমি পারব। জীবন আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে। সেই সুযোগকে আমার জেতার গল্পে পরিণত করতেই হয়েছিল।”
প্রিয়াংকার এই অসাধারণ যাত্রা প্রমাণ করে—ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো বাধাই অদম্য নয়। জীবনের কঠিনতম মুহূর্তকেও জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি শুধু প্রিয়াংকার মতো মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। তাঁর সাফল্য আজ লক্ষ কোটি মানুষের প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
HindusNews পরিবারের পক্ষ থেকে প্রিয়াংকা রায়কে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভকামনা।
আপনার জীবনের এই বিজয়গাথা আমাদের সমাজের অসংখ্য তরুণ–তরুণীর জন্য এক আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।