
হাজিরা শেষে আদালত চত্বরে বাউল শিল্পীদের ওপর হামলা, আতঙ্কে সাংস্কৃতিক অঙ্গন
নিজস্ব প্রতিবেদক :
ঠাকুরগাঁও জজ কোর্ট চত্বরের ভেতরে চা পান করার সময় আকস্মিকভাবে অজ্ঞাত একদল লোকের হামলার শিকার হয়েছেন চারজন বাউল শিল্পী। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, হামলাকারীরা ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিতে দিতে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মারধর করতে করতে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। দেশের শান্তিপূর্ণ লোকসংস্কৃতি চর্চার পরিবেশে এমন হামলা বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও নিন্দার ঝড় উঠেছে।
ঘটনার পর বৃহস্পতিবার দুপুরে আহত শিল্পীদের একজন মো. মকলেস ঠাকুরগাঁও সদর থানায় অজ্ঞাতনামা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তার আগের দিন, অর্থাৎ বুধবার দুপুরে হামলার পর মকলেসসহ তাঁর সঙ্গী মোখলেছুর রহমান, মজিদ সরকার এবং মো. সামসুদ্দিন চিশতীকে দ্রুত উদ্ধার করে ঠাকুরগাঁও সদর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বৃহস্পতিবার তাঁদের সবাইকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মনজুরুল ইসলাম।
জিডিতে উল্লেখ করা হয়, বুধবার বেলা দুইটার দিকে আদালতে হাজিরা শেষে মকলেস তার গুরু বাউল শামসুদ্দিন, মজিদ সরদার এবং দীপকের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁরা সবাই কান্তজীউ মন্দিরের মেলায় অংশ নিতে ওই এলাকায় অবস্থান করছিলেন। আদালত চত্বরে চা পান করার মুহূর্তে হঠাৎই একদল লোক স্লোগান দিতে দিতে তাঁদের দিকে ধেয়ে আসে এবং কোনো সতর্কতা ছাড়াই মারধর শুরু করে। হামলাকারীদের কাউকে শনাক্ত করতে পারেননি ভুক্তভোগীরা। তাঁদের দাবি, হামলাকারীরা শুধু শারীরিক নির্যাতনই করেনি, ভয়াবহ হুমকিও দিয়েছে।
মকলেস জানান, তাঁরা কিছুই বুঝে ওঠার আগেই চার-পাঁচজন প্রথমে আক্রমণ শুরু করে এবং পরে আরও কয়েকজন তাতে যোগ দেয়। ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে ছুটে পালিয়ে যান এবং স্থানীয়দের সহায়তায় হাসপাতালে পৌঁছান। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর নিরাপত্তার কারণে শামসুদ্দিনকে দ্রুত জয়পুরহাট এবং মজিদ সরকারকে সাভারগামী ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। এই আকস্মিক চলে যাওয়া তাঁদের নিরাপত্তাজনিত উৎকণ্ঠাকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
ঠাকুরগাঁও শহরের আট গ্যালারি এলাকার পাগলু স্ট্যান্ডের সভাপতি খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, বাউল মকলেস দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের স্ট্যান্ডে নাইট গার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েই তিনি গণপিটুনির মতো হামলার শিকার হয়েছেন বলে তাঁর ধারণা।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর থানার অফিসার ইনচার্জ সরোয়ারে আলম খান বলেন, জিডি গ্রহণ করা হয়েছে এবং আদালতের অনুমতি নিয়ে তদন্ত শুরু হবে। হামলাকারীদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তবে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
লোকসংস্কৃতি, বাউল চর্চা এবং উন্মুক্ত ভাবধারার জন্য পরিচিত এই সম্প্রদায়ের ওপর প্রকাশ্যে হামলা বাংলাদেশে মতপ্রকাশ, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিকতার ওপর একটি দুঃসাহসী আঘাত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঘটনার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন শিল্পী ও সংস্কৃতিমনা মানুষজন। বাউলদের দীর্ঘদিনের মানবতাবাদী ঐতিহ্য ও শান্তির বার্তা যেখানে দেশের গৌরব, সেই সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর এমন হামলা নিঃসন্দেহে গভীর উদ্বেগের কারণ।