
হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছে দান করুন!
কোলকাতা থেকে সুধাংশু :
বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের হিন্দুরা তো বটেই, উত্তর-পূর্ব ভারতের পাঁচ রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ-মালদহ- বসিরহাট কিংবা কেরলের বিভিন্ন এলাকা সহ ভারতের যেসব অঞ্চলে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে, তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, কত ধানে কত চাল। কাশ্মীর ভ্যালি থেকে তো হিন্দুদের রাতারাতি একেবারে মুছেই ফেলা হয়েছে। যেসব অঞ্চলে ক'দিন বাদে হিন্দুরা টিকেই থাকতে পারবে না, সেখানে জাতিগত নীলরক্ত কিংবা শাস্ত্রীয় বিশুদ্ধতা নিয়ে, ঝগড়াঝাটি মারামারি হানাহানি করে কি কোন লাভ আছে!
গ্রেটার রাজশাহী অঞ্চলের একটি সাঁওতাল ছেলে আমার কাছে লিখেছে, তাদের সমাজের সিংহভাগ মানুষ অন্যধর্মে চলে গেছে। তার পরিবারটি সহ মাত্র অল্প কয়েক ঘর আদিবাসী, এখনো সনাতন সমাজে টিকে আছে। কিন্তু বাঙালি হিন্দুরা তাদের মন্দিরে ঢুকতে দেয় না; বলে 'তোমরা অশুচি, মন্দির অপবিত্র হয়ে যাবে'। বাঙালি হিন্দুরা কথায় কথায় তাদের 'বুনো' বলে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করে। এমত অবস্থায় তাদের পক্ষে আর হিন্দু সমাজে টিকে থাকা সম্ভব নয়...
বঙ্গদেশে যদি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ না করতেন এবং বৈষ্ণব ও মতুয়া মতাদর্শের অভ্যুদয় না ঘটতো, তাহলে কোটি কোটি অস্পৃশ্য ও অবহেলিত মানুষ হিন্দু সমাজে টিকে থাকতে পারতো না, তারা অন্য ধর্মে চলে যেতে বাধ্য হতো। তাহলে বাঙালি হিন্দুর সংখ্যা এত বিশাল আকারে কমে যেত যে, ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়- হিন্দু বাঙালিদের হোমল্যান্ড 'পশ্চিমবঙ্গ' সৃষ্টি করতে পারতেন না। নিজস্ব আবাসভূমি না থাকার ফলে সিন্ধিভাষী হিন্দুরা যেভাবে হারিয়ে গেছে, বাংলাভাষী হিন্দুরাও একই ভাবে এতদিনে বিলীন হয়ে যেত।
বৃহত্তম রংপুর অঞ্চলের এক বৈষ্ণব যুবক,
শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজের স্বল্প সামর্থ সত্ত্বেও- অস্পৃশ্য শ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে সীমিত আকারে সেবামূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে- যাতে তারা ধর্মান্তরিত হয়ে না যায়। গতবছর শীতকালের এক গভীর রাতে, সে আমার ঘুম ভাঙিয়ে জানায়, "দাদা,আমি নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করেছি... এইমাত্র স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আমি সপরিবারে ধর্মান্তরিত হবো। আমি খ্রিস্টধর্মে যাব না, আমি ইসলাম ধর্মে চলে গিয়ে,এই শুয়োরের বাচ্চা জাতিকে কালাপাহাড়ের মতো উচিত শিক্ষা দেব..."
ঘটনা হচ্ছে, ঐ যুবক তার পিতৃশ্রাদ্ধে সেই সব অস্পৃশ্য শ্রেণীর হিন্দুদের নেমন্তন্ন করেছে- যাদের মধ্যে সে সেবামূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। শিশু-বৃদ্ধ মিলিয়ে এদের সংখ্যা ৭০/৮০ জনের বেশি হবে না। পঙ্কজ ভাদর নামক ঐ অঞ্চলের একজন প্রভাবশালী ধর্মগুরু ফতোয়া দিয়েছে, অস্পৃশ্য শ্রেণীর হিন্দুরা যদি ঐ যুবকের বাড়িতে খেতে যায়, তাহলে স্থানীয় বর্ণহিন্দুরা ঐ যুবকের পিতৃশ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান বর্জন করবে এবং ঐ যুবককে সামাজিকভাবে এক ঘরে করে রাখা হবে।
ঐ যুবকের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা শেষে বাকী রাতটুকু নির্ঘুম কাটিয়ে, ভোরবেলা উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত সমাজসেবক ও শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণ ব্যক্তিত্ব সুব্রত ভট্টাচার্য মহাশয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানতে পারি, ঐ যুবক তার সরাসরি ছাত্র এবং তার মানবতাবাদী আদর্শের অনুসারী। সুব্রত ভট্টাচার্য ঐ যুবককে বুঝানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
উত্তরবঙ্গের এক ব্যক্তি,আমার কয়েকটি লেখা
স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ করে। সেই লেখার সূত্রে ঐ এলাকার কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দু ও চিন্তাশীল ছেলেমেয়ে সামাজিক মাধ্যম ও টেলিফোনে আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো (অনিবার্য কারণে এখন আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না)। একটি চিন্তাশীল ছেলের বিশেষ অনুরোধে, ধর্মগুরু পঙ্কজ ভাদরের সঙ্গে আলোচনা করি। তাকে সরাসরি বলি, "আপনি যেভাবে বিভেদ-বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি-ফতোয়া দিচ্ছেন, তাতে অস্পৃশ্য শ্রেণীর হিন্দুরা ধর্মান্তরে উৎসাহিত হচ্ছে..."
পঙ্কজ ভাদর উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি। সে বলে,"মহাশয়, আমি আপনার লেখার সঙ্গে পরিচিত। আপনি পাশবিক ভোগবাদী উগ্র চার্বাকপন্থী... আপনি আব্রাহামিকদের মতো হিন্দুদের বিষয়মুখী করে তুলতে চাইছেন... রাজা রামমোহন রায়ের মতো আপনার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আপনার সমস্ত চিন্তার অপমৃত্যু ঘটবে..."
রাজা রামমোহন রায়ের পায়ের ধুলার যোগ্যতাও আমার নাই। আমি নিজে আমার কোন রচনা সংরক্ষণ করার চেষ্টা করি না; বিক্ষিপ্ত ভাবে বিভিন্ন জায়গায় একধিক নামে লিখি। সুতরাং আমার মৃত্যুর পরে আমার সমস্ত চিন্তা যে মুছে যাবে - পঙ্কজ ভাদরের এই ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণ সত্য। তবে আমি লক্ষ্য করেছি, বিভিন্ন গ্রুপ, পেইজ, অনলাইন পত্রিকায় আমার রচনা পুনর্মুদ্রিত হয় - বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার নাম বদলে দিয়ে, যে যার নামে চালিয়ে দেয়। আমার চিন্তা যদি আমার নামে প্রচলিত না-ও থাকে, তবুও অন্যের মাধ্যমে - অন্যের নামে প্রচারিত হয়েও, আমার চিন্তা ভবিষ্যত-প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে পারে।
হিন্দুজাতিই যদি টিকে থাকা থাকতে না পারে, তাহলে আমার চিন্তার কোন সার্থকতাই নেই। বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যা কমতে কমতে ৮%-এ নেমে এসেছে। মিস্টার পঙ্কজ ভাদর, আপনারা শাস্ত্রীয় বিশুদ্ধতার নামে হিন্দুসমাজ থেকে লোক তাড়িয়ে দিচ্ছেন! আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশ যখন হিন্দুশূন্য হয়ে যাবে, কাদের ভাঙিয়ে ধর্ম-ব্যবসা করবেন!