

কক্সবাজারের চকরিয়ায় জাগ্রত কালী মায়ের অলৌকিক আবির্ভাব—জাগ্রত কালী মন্দির প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণ ইতিকথা
হৃদয় দাশ – কক্সবাজার প্রতিনিধি
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের ভরামুহুরী হিন্দু পাড়ায় অবস্থিত “চকরিয়া কেন্দ্রীয় কালী মন্দির” আজ শুধু একটি পূজাস্থল নয়, বরং আধ্যাত্মিক শক্তি ও অলৌকিক ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে খ্যাত। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ও দেবীর উপস্থিতির গল্প শত শত ভক্তের মুখে মুখে প্রচলিত। তবে কালী মন্দিরের ইতিহাস বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে এর পাশেই অবস্থিত “মা ইছামতি মন্দির”-এর আদিকথা—যেখানে দেবী প্রথমবার গ্রামের মানুষকে নিজের উপস্থিতির জানান দিয়েছিলেন।
ভরামুহুরী গ্রামের স্বনামধন্য কবিরাজ চন্দ্রকুমার দাশ গুপ্ত একদিন নদীপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে মাতামুহুরী নদীর মাঝখানে লাল পাড়ের শাড়ি পরিহিতা এক নারীসত্তাকে দেখতে পান। তিনি ধর্মপ্রাণ হওয়ায় ভয় পাননি, কিন্তু সেই দৃশ্যের রহস্য জানতে পারেন পরে, যখন স্বপ্নে মা ইছামতি নিজে এসে নির্দেশ দেন ঘট স্থাপন করে তাঁর পূজা করার জন্য। এই নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয় মা ইছামতি মন্দির। কবিরাজের জীবনে পরে আরও বহুবার দেবীর অলৌকিক উপস্থিতি অনুভূত হয়। বিশেষত এক অন্ধকার রাতে যখন বাড়ি ফেরার ভয়ে তিনি দেবীর নাম স্মরণ করলেন, তখনই তার সামনে দেখা যায় আলোকচ্ছটা, যা তাকে পথ দেখিয়ে বাড়ির ফটক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। গ্রামের বহু মানুষ এই ধরনের রহস্যময় আলোর সাক্ষী ছিলেন।
এই আধ্যাত্মিক ধারারই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় কালী মন্দির। পূর্বে এটি ছিল একটি ছোট হরি মন্দির, যেখানে পূজা করতেন গণেশ চক্রবর্তী। দেশভাগের সময় তিনি ভারতে চলে গেলে চন্দ্রকুমার নতুন পূজারী হিসেবে আনেন মোহনকৃষ্ণ চক্রবর্তীকে। মন্দিরের পাশের কুমার পুকুরের পশ্চিম পাড়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুই বেল গাছকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা, যা পুরো গ্রামে আলোড়ন তোলে। কবিরাজের নাতি সুধীর দাশ গুপ্ত ও তাঁর সঙ্গী শিবশংকর দাশ একদিন বেল পাড়ার উদ্দেশ্যে গাছে উঠতে গেলে সুধীর হঠাৎ অদৃশ্য এক নারী কণ্ঠের নিষেধ শুনতে পান। সে নিষেধ অমান্য করে গাছে উঠতেই অদৃশ্য শক্তি তাকে জোরে নিচে ফেলে দেয়। পরে সবাই বুঝতে পারে—এটি মা কালী নিজেই ছিলেন, যিনি বহুদিন ধরে দক্ষিণ পাড়া থেকে উত্তর পাড়া পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতেন, এবং যাকে অনেকে অমাবস্যার রাতে আলোকচ্ছটার মাঝে দেখতে পেতেন।
এরপর মন্দিরের পূজারী মোহনকৃষ্ণ চক্রবর্তী স্বপ্নে মা কালীকে দেখতে পান। দেবী তাকে জানান, বৃষ্টিতে-রোদে ভিজে বেল গাছের ডালে তিনি কষ্টে আছেন। তাঁকে যেন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সময় পূজারী দেবীর কাছে নিজের দারিদ্র্যের কথা বললেও মা জানান—যা দেওয়া হবে, তাকেই তিনি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবেন। দেবী বেল গাছের একটি বিশেষ ডাল চিহ্নিত করে বলেন, প্রতি বছর সেই ডালে জোড়া বেল ধরে, আর সেই ডালই প্রতিমার ভিতরে স্থাপন করতে হবে। কালী মা পরে কবিরাজ চন্দ্রকুমারকেও একই স্বপ্ন দেখান। এরপর সবাই মিলে সেই বেল ডাল সংগ্রহ করে প্রতিমার কাঠামো তৈরি করেন। বিস্ময়ের বিষয়, প্রতিমা তৈরির অল্পদিনের মধ্যেই বেল গাছটি শুকিয়ে মারা যায়। শ্রীমৎ স্বামী চিন্তাহরণ পুরী মহারাজ প্রতিমাটি ঘষেমেজে শোভামণ্ডিত করে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন, এবং সেদিন থেকেই হরি মন্দিরটি রূপান্তরিত হয় বর্তমানের কালী মন্দিরে।
গ্রামটি তখন এতটাই দরিদ্র ছিল যে ভক্তদের ঠিকভাবে পূজা দেওয়াও সম্ভব হতো না। তবে সময়ের সাথে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। ভরামুহুরী গ্রামবাসীর বিশ্বাস—এ পরিবর্তন মা কালী ও মা ইছামতিরই কৃপা। পূজা-অর্চনা বাড়তে থাকে, ভক্তদের আগমনও বৃদ্ধি পায়।
মায়ের অলৌকিক উপস্থিতির বহু ঘটনাই আজও ভক্তদের মনে জীবন্ত। গ্রীষ্মের এক রাতে সমীর দাশ গুপ্ত নামের এক যুবক মন্দিরের মাঝখানে শুয়ে পড়লে ঘুমের মধ্যেই মা তাকে উপরে তুলে নিচে ফেলে দেন। ভয়ে সে মিথ্যা বলে বাড়িতে পালিয়ে যায়, পরে ঘটনা স্বীকার করে। আবার এক মহোৎসবের বিকেলে এক ভক্ত মন্দিরের আমগাছের ডালের উপর লাল শাড়ি পরিহিতা এক আলোকিত নারীমূর্তি দেখেন। কয়েক মুহূর্ত তাকানোর পর সে দৃশ্য অদৃশ্য হয়ে যায়—কিন্তু সবাই নিশ্চিত হন যে মা কালীই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে আমগাছটি দেবীর বিশ্রামের স্থান হিসেবে পরিচিত হয়।
অলৌকিক ঘটনা, শক্তির উপস্থিতি এবং দেবীর করুণাময় আশীর্বাদে চকরিয়া কেন্দ্রীয় কালী মন্দির আজ কক্সবাজার জেলার অন্যতম প্রসিদ্ধ আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য ভক্ত আজও এখানে আসেন মায়ের জাগ্রত রূপের দর্শনে।