
বিএনপির নতুন তালিকায়ও নেই কোনো হিন্দু প্রার্থী: সংকুচিত হচ্ছে রাজনৈতিক পরিসর, বাড়ছে হিন্দুশূন্য সংসদের আশঙ্কা
রাজনৈতিক ডেস্ক :
বিএনপি বৃহস্পতিবার আরও ৩৬টি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। তবে নতুন ঘোষিত এই তালিকাতেও একজন হিন্দু প্রার্থীর নাম নেই। এর আগে দুই দফায় ঘোষিত মনোনয়নসহ মোট ২৭২টি আসনে এখন পর্যন্ত প্রার্থী দিয়েছে দলটি, যার মধ্যে মাত্র দু’জন হিন্দু। এই দুইজনকে নিয়েও স্থানীয় পর্যায়ে তীব্র বিতর্ক ও বিরোধিতা দেখা দেওয়ায় তাদের নির্বাচনী সম্ভাবনা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আসন্ন জাতীয় সংসদে হিন্দু প্রতিনিধিত্ব শূন্যের কোঠায় নেমে আসার ঝুঁকি এখন অত্যন্ত প্রবল।
বিএনপির সাম্প্রতিক মনোনয়ন–প্রক্রিয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর হতাশা সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের মতে, দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় হিন্দু রাজনীতিবিদদের দীর্ঘদিনের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে তাদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে দলটির অনীহা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি এমন যে, হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব সঙ্কুচিত হয়ে একটি প্রতীকী অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ মনে করছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতরকার বিভক্ত নেতৃত্ব ও অদক্ষ রাজনৈতিক কৌশল আজকের এই অবস্থার জন্য সমানভাবে দায়ী। অনেকেই অভিযোগ করছেন—বিএনপির ভেতরে থাকা হিন্দু নেতাদের একটি অংশ জাতীয় রাজনীতির চেয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মন্দির কমিটি কিংবা ট্রাস্টের পদ দখলেই বেশি আগ্রহী; ফলে প্রকৃত রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ধর্মীয় কাঠামোর ভেতরে সীমাবদ্ধ থেকে রাজনৈতিক দাবিদাওয়া তুলে ধরার সুযোগ থাকে না, যেটা সরাসরি সংসদ ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণের বিকল্প হতে পারে না।
হিন্দু ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা মনে করেন, সম্প্রদায়ের টিকে থাকা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো কেবল ধর্মীয় কমিটি কিংবা কল্যাণ ট্রাস্টের ওপর নির্ভর করে সমাধান করা সম্ভব নয়। বরং জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ছাড়া নিরাপত্তা ও প্রতিনিধিত্বের বাস্তব নিশ্চয়তা মিলবে না। বিশেষজ্ঞ মহলের একটি অংশ বলছে, যদি ৫ আগস্টের পর পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি বাস্তবায়নের দাবিতে হিন্দু সমাজ ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিত, তাহলে অন্তত ৪২টি আসনে হিন্দু প্রার্থী নির্বাচনের সুযোগ ছিল। কিন্তু বিভক্ততা, অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবে সেই সম্ভাবনাটি নষ্ট হয়ে গেছে।
পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক এক জরুরি ফেসবুক পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, বিএনপি আরও ৩৬টি আসনে মনোনয়ন ঘোষণা করলেও একজনও হিন্দু প্রার্থীকে জায়গা দেয়নি। এখন পর্যন্ত ঘোষিত ২৭২টি আসনের মধ্যে হিন্দু প্রার্থীর সংখ্যা মাত্র দুই, অথচ এদের বিরুদ্ধেও স্থানীয় নেতাদের প্রকাশ্য বিদ্রোহ রয়েছে। তার মতে, তারা নির্বাচিত হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। তিনি আরও অভিযোগ করেন, বিএনপির ভেতরের কিছু হিন্দু নেতা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দখল করে সেগুলোকে রাজনৈতিক আখড়ায় পরিণত করায় হিন্দুধর্মের সার্বিক ক্ষতি হচ্ছে।
তার মন্তব্যে আরও উঠে এসেছে, “হিন্দুরা অতি বুদ্ধিমান, ঘরে ঘরে পণ্ডিত, তাই হাজার বছর ধরে শুন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে”—যা একটি কঠিন বাস্তবতাকে সামনে এনে দিয়েছে। ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়া রাজনৈতিক ক্ষেত্র, বিভক্ত নেতৃত্ব ও কৌশলগত ব্যর্থতা মিলিয়ে হিন্দুদের সামনে এখন এক গভীর অনিশ্চয়তার সময়।
দেশের রাজনীতিতে বহু বছর পর একটি হিন্দুশূন্য সংসদ গঠিত হওয়ার শঙ্কা যে বাস্তবে রূপ নিতে পারে, বিএনপির মনোনয়ন তালিকা সেই আশঙ্কাকেই আরও জোরালো করে তুলেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য প্রশ্ন এখন শুধু প্রতিনিধিত্বের নয়—বরং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অস্তিত্বের।