
ঘানায় সনাতন ধর্মের অগ্রদূত স্বামী ঘনানন্দ সরস্বতী: আফ্রিকার মাটিতে বৈদিক আলোর দীপশিখা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলের দেশ ঘানায় সনাতন ধর্মের আলো পৌঁছেছে এক অনন্য ব্যক্তিত্বের হাত ধরে, যিনি পরিচিত স্বামী ঘনানন্দ সরস্বতী নামে। সনাতন ধর্মের মহত্ত্ব, এর সার্বজনীনতা ও মানবিক আদর্শ যে কেবল ভারতবর্ষেই সীমাবদ্ধ নয় বরং বিশ্বের সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত—স্বামী ঘনানন্দ তার জীবনযাত্রা দিয়ে সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মানবধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই চিরন্তন আদর্শ ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে সূদূর আফ্রিকার ভূমিতেও, যেখানে তিনি হয়ে উঠেছেন প্রথম সনাতন সন্ন্যাসী এবং আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক।
ঘানার এক দরিদ্র আদিবাসী পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। জীবনের শুরুতে পরিবার খ্রিষ্টমত গ্রহণ করলেও শৈশব থেকেই তার ঝোঁক ছিল মহাবিশ্বের রহস্য, আধ্যাত্মিকতা ও ভিন্ন ধর্মগ্রন্থের প্রতি। সত্যের অনুসন্ধানে তিনি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়তে শুরু করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈদিক শাস্ত্রই তার মনে গভীর আলোড়ন তোলে। ঋগ্বেদের ‘‘মনুর্ভব জনয়া দৈব্যং জনম্’’ শ্লোকের যে মূল অর্থ—নিজে প্রকৃত মানুষ হও এবং অন্যকেও মানুষ করে তোলা—এই বাণী তার আধ্যাত্মিক জীবনকে নতুন দিশা দেয়। সেই দিশাই তাকে নিয়ে আসে ভারতবর্ষে, উত্তরাখণ্ডের ঋষিকেশে, যেখানে তিনি বিভিন্ন আধ্যাত্মিক গুরু ও সন্ন্যাসীর সান্নিধ্যে এসে আরও গভীর শিক্ষালাভ করেন।
ঋষিকেশের সাধু–সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মেলামেশা তার মনোভাবকে পরিষ্কার করে দেয়—তিনি নিজ দেশে ফিরে মানবিকতা, সনাতন আদর্শ ও বৈদিক জ্ঞান ছড়িয়ে দেবেন। ঘানায় ফিরে ১৯৬২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ডিভাইন মিস্টিক পাথ সোসাইটি’, যা ছিল সনাতন ধর্ম সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা তৈরির প্রথম আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ। একইসঙ্গে তিনি ভারতের ডিভাইন লাইফ সোসাইটির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, পাঠ নিতেন, এবং আত্মোন্নয়নের পথে অগ্রসর হতেন।
তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় যখন তিনি স্বামী কৃষ্ণানন্দের সান্নিধ্যে আসেন। বহু বছর সাধনা ও শিক্ষালাভের পর ১৯৭৫ সালে স্বামী কৃষ্ণানন্দ তাকে সন্ন্যাস দীক্ষা দেন। দীক্ষার পর তিনি ‘স্বামী ঘনানন্দ সরস্বতী’ নামে পরিচিতি লাভ করেন এবং ইতিহাসে স্থান করে নেন ঘানার প্রথম হিন্দু সন্ন্যাসী হিসেবে।
দীক্ষার পর তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেন ঘানার সাধারণ মানুষের কাছে সনাতন ধর্মের শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে। বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন কীভাবে সনাতন ধর্ম মানবিকতা, সত্য, প্রেম ও শৃঙ্খলার শিক্ষা দেয়। তার আধ্যাত্মিক উপদেশ, যোগসাধনা, ভগবদ্গীতা ও উপনিষদের ব্যাখ্যা শুনতে অসংখ্য মানুষ সমবেত হতেন। নারী–পুরুষ, তরুণ–বৃদ্ধ, কালো–সাদা—সবাই তার কাছে পেয়েছেন একই মানবিক স্নেহ, একই আলোকপ্রদ দিশা।
আজ ঘানায় এবং আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলে সনাতন ধর্ম সম্পর্কে যে সচেতনতা দেখা যায়, তার পেছনে রয়েছেন স্বামী ঘনানন্দ সরস্বতীর নিরন্তর প্রচেষ্টা। তিনি প্রমাণ করেছেন যে জন্ম, ভাষা বা জাতিই মানুষের পরিচয় নয়; প্রকৃত পরিচয় তার মানবিকতা। তার জীবন যেন সনাতন ধর্মের উদারতা ও সার্বজনীনতার জীবন্ত প্রতীক, যেই ধর্ম মার্গারেট নোবেলকে করেছে ভগিনী নিবেদিতা, স্যামুয়েল স্টোকসকে করেছে সত্যনন্দ, সেই ধর্মই ঘানার এক আদিবাসী সন্তানকে করেছে স্বামী ঘনানন্দ সরস্বতী।