
স্ত্রী দূর্গাবতীর প্রতি রাজা শিবনারায়ণ রায়ের ভালোবাসার নিদর্শন : দুর্গাসাগর দীঘি প্রকৃতির লীলাভূমি
সুমন দেবনাথ, বরিশাল প্রতিনিধি :
স্ত্রীকে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে খনন করা দুর্গাসাগর দীঘি দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অতুলনীয় লীলাভূমি। ইতিহাস সমৃদ্ধ বরিশাল নদী-খাল আর সবুজের বেষ্টনিতে সাজানো এই জনপদ—একসময় ছিল চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের প্রভাবশালী রাজ্য। তাঁদের বহু স্থাপনা ও স্মৃতি আজও ছড়িয়ে আছে মাধবপাশা অঞ্চলের গ্রামগুলোতে, আর সেইসব স্মৃতির মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন হলো দুর্গাসাগর দীঘি।
জনশ্রুতি এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রে জানা যায়, ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ পরগনার পঞ্চদশ রাজা শিব নারায়ণ রায় তাঁর স্ত্রী রানী দুর্গাবতীর প্রতি গভীর অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দীঘিটি খনন করান। প্রচলিত আছে, রানী এক রাতে যতদূর হাঁটতে পেরেছিলেন, ঠিক ততটুকু আয়তন জুড়েই খনন করা হয় এই বিশাল জলাধার। প্রায় ৬১ কানি জমি জুড়ে বিস্তৃত এই দীঘি রানীর নামেই পরিচিত হয়—দুর্গাসাগর নামে।
সরকারি হিসাবে প্রায় ৪৫.৪২ একর আয়তনের এই দীঘির ২৭ একরই জলভাগ। উত্তর-দক্ষিণে এর দৈর্ঘ্য ১৪৯০ ফুট আর পূর্ব-পশ্চিমে ১৩৬০ ফুট। সময়ের স্রোতে দীঘির প্রাচীন জৌলুস কিছুটা ম্লান হলেও প্রকৃতির যাদু এখনো তাকে টেনে রাখে অসংখ্য দর্শনার্থীর কাছে। শীত এলেই দূর সাইবেরিয়া থেকে সরাইল, বালিহাঁসসহ নানা পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। তাদের সাঁতার, ডানা ঝাপটা আর কূজন দীঘিপাড়ের পরিবেশে তুলে ধরে অপার্থিব শান্তির সুর।
ইংরেজ শাসনামলে একবার দীঘিটি সংস্কার করা হয়, আর স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে সরকারের উদ্যোগে আবারও পুনর্গঠন করা হয়। দীঘির মাঝ বরাবর টিলা তৈরি করে গড়ে তোলা হয় অবকাশ কেন্দ্র। পরে চারদিকে নারিকেল, সুপারি, শিশু ও মেহগনিসহ নানান বৃক্ষরোপনের ফলে সৃষ্টি হয় মনোরম সবুজ বেষ্টনী। সময়ের পরিবর্তনে কিছু ঘাট হারিয়ে গেলেও পশ্চিম পাড়ে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো এখনো ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করে।
বরিশাল শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত মাধবপাশার এই দীঘি খুব সহজেই পৌঁছে যায়। নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস বা মাহিন্দ্রায় অর্ধঘণ্টার পথ। দীঘির পাশে নামলেই দেখা মিলবে প্রবেশদ্বারের। মাত্র ১০ টাকার টিকিটে যে কেউ যতক্ষণ ইচ্ছা এখানে সময় কাটাতে পারেন। প্রকৃতির অসংখ্য উপহার যেন অপেক্ষা করে থাকে প্রতিটি আগন্তুকের জন্য—চারপাশের গাছপালার ফাঁক দিয়ে দমকা হাওয়া, দীঘির জলে পা ডুবিয়ে রাখার শান্তি, কিংবা মাঝ টিলার নিস্তরঙ্গ ছায়াঢাকা পথ—সব মিলিয়ে এক লহমায় মনকে ভরিয়ে তোলে প্রশান্তিতে।
সম্প্রতি দীঘির দক্ষিণাংশজুড়ে দেখা মিলছে শ্বেতপদ্মের অপরূপ সমাহার। কেয়ারটেকার তপন লাল লস্কর জানান, এ বছর প্রথমবারের মতো স্বাভাবিকভাবে এত বিপুল পরিমাণ সাদা পদ্ম ফুটেছে, আর এই দৃশ্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এখানে পাখিদের অভয়ারণ্য গড়ে তোলা, মাছ অবমুক্তকরণ, এবং দীঘিতে হাঁস ছাড়া—এসবই পর্যটন সুবিধা আরও বাড়িয়েছে।
হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে দুর্গাসাগর বিশেষ পূণ্যস্থান। প্রতি বছর চৈত্র মাসের অষ্টমীতে এখানে হাজারো মানুষ স্নানে অংশ নেন। বরিশালের মুন্সিগ্রেজ এলাকার পাপড়ি রানি বৈদ্য বলেন, “গত বারো বছর ধরে অষ্টমীর দিনে ব্রহ্মা দেব ও গঙ্গা দেবীর কৃপা লাভের আশায় এখানে স্নান করি। এই দীঘির শান্তি অন্য কোথাও পাই না।”
দুর্গাসাগরের পাশেই আছে বায়তুল আমান জামে মসজিদ কমপ্লেক্স এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের জন্মভিটায় স্থাপিত জাদুঘর—যা ভ্রমণকারীদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ।
প্রকৃতি ও ইতিহাসের মিলিত মূর্ছনায় দুর্গাসাগর দীঘি শুধু একটি জলাধার নয়, বরং এটি বরিশালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মানুষের অনুভূতি, আর এক অনন্ত প্রেমকাহিনির জীবন্ত প্রতীক।