ইতিহাস–ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ কালের সাক্ষী সাতানি জমিদার বাড়ি

2 days ago
VIEWS: 57

সুমন দেবনাথ, বরিশাল প্রতিনিধি

বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের দত্তপাড়া গ্রামে অবস্থিত সাতানি জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের এক অমূল্য ঐতিহাসিক ধন। প্রায় ২২ একরজুড়ে বিস্তৃত এই জমিদার বাড়ির ২৪টি দালান আজো দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। নদীবেষ্টিত বরিশালের মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির মাঝেই জমিদার বাড়িটি গড়ে উঠে একসময়কার সাংস্কৃতিক বিকাশ, ধর্মীয় আচার, সামাজিক প্রভাব ও জমিদারি ঐশ্বর্যের কেন্দ্র হিসেবে। স্থানীয়রা একে সাতানি মন্দির এলাকা বা দত্তপাড়া জমিদার বাড়ি নামেও ডাকেন।

জমিদার বাড়ির স্থাপত্যে ছিল বৈচিত্র্য ও শক্তিশালী নির্মাণশৈলী। বর্গীদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এখানে নির্মিত হয়েছিল দুটি বিশেষ দালান—যাদের প্রতিটিতে ছিল একটি দরজা আর দুটি জানালা। ছিল বালাখানা, যেখানে নায়েবরা বসতেন। বাড়ির কয়েকটি দালান ব্যবহৃত হতো মন্দির হিসেবে—রাধামাধব মন্দির, দুর্গামন্দির, নারায়ণ ও মনসা মন্দির ছিল সেসবের মধ্যে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, একই মন্দিরে কখনো একসঙ্গে তিনটি দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। একসময় হতো মহিষ বলিদান, পরে তা বন্ধ হয়ে মন্দিরে ভোগ দেওয়া শুরু হয়। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যাত্রা, থিয়েটারসহ নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে সরগরম থাকত এই বিশাল বাড়িটি। এখনো পাশের মন্দিরে ১০ হাত কালীমূর্তির কালীপূজা সাতানির ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছে।

শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ ছিল সাতানির জমিদার বাড়ি। এখানে চালু ছিল একটি পঞ্চম শ্রেণির স্কুল, যার দায়িত্বে ছিলেন পণ্ডিত ইন্দির আইচ। শিক্ষকতা করেছেন নিমাচাঁদ চক্রবর্তীও। ধর্ম খার বংশের মতিলাল ভৌমিক ছিলেন বাইশারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনারারি শিক্ষক, যিনি কখনো বেতন নিতেন না। ভারতবর্ষের বিখ্যাত খোলবাদক ভীম ভৌমিকও এই এলাকার গর্ব। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন ডা. লক্ষ্মীকান্ত ভৌমিক ও ডা. সূর্য কান্ত সাহা। বর্তমানে ডা. সূর্য কান্ত সাহারই পুত্র ডা. উত্তম কুমার সাহা বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।

মুঠোফোনে কথা বলতে গিয়ে ডা. উত্তম সাহা জানান—তাদের অনেক পূর্বপুরুষ মারা গেছেন, কেউ ছড়িয়ে পড়েছেন ভারত ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে। জমিদার বাড়িটি বহু বছর আগে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়—যদিও এর সঠিক সাল জানা যায়নি। তিনি জানান, স্থানীয়ভাবে লিজের নামে সাতানি জমিদার বাড়ির অনেক মূল্যবান গাছপালা কেটে নেওয়া হয়েছে, যা ঐতিহ্যের ক্ষতি করেছে। তার কাকা শহীদ সৈনিক আদিত্য সাহার সমাধি একসময় এই জমিদার বাড়িতে ছিল। বান্দরবনের রামুতে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। পরবর্তীতে বেদখলের কারণে সমাধিমন্দিরটি ভেঙে ফেলা হয়। সরকারের কাছে তিনি দাবি জানান—অর্পিত বা দখলকৃত এই সম্পত্তি যেনো মূল মালিকদের কাছে ফেরত দেওয়া হয় এবং লিজ দিলে প্রকৃত মালিকদেরই দেওয়া হয়।

সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বানারীপাড়াকে গড়ে তুলেছিলেন যেসব জমিদার পরিবার, তাদের স্মৃতিই আজো জীবন্ত রাখে সাতানি জমিদার বাড়ির দালানগুলো। কেন্দ্রীয় সার্বজনীন মন্দিরের সভাপতি দেবাশীষ দাস বলেন—এই ঐতিহাসিক বাড়ি ও এর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকেই এলাকার সমৃদ্ধি বিস্তার লাভ করে। তিনি মনে করেন, উত্তরাধিকারীদের শেকড়ের সঙ্গে সংযোগ থাকা জরুরি এবং সরকারিভাবে এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা গেলে সেটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় হবে। একইভাবে স্থানীয় শিক্ষক, বাচিক শিল্পী ও প্রবন্ধকার বিশ্বনাথ রায় মনে করেন—দত্তপাড়া জমিদার বাড়িটি অমূল্য সম্পদ এবং এটিকে সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি।

জমিদার বাড়ির প্রবেশমুখেই আছে একটি সহমরণ সমাধিক্ষেত্র, যা ভারতবর্ষের পুরোনো সহমরণ প্রথার বিরল নিদর্শন। একসময় সরগরম ও মানুষের বসতিপূর্ণ বাড়িটি এখন নীরব ও পরিত্যক্ত। লতা-গুল্মে ঢেকে গেছে দালানের দেয়াল। চামচিকা, সাপ, কাঠবিড়ালি, বেজি আর নানা জীবজন্তু এখন এই বাড়ির নিত্যসঙ্গী। স্থানীয়দের আক্ষেপ—ইতিহাসের এমন নিদর্শন কি আমরা আরেকবার নতুন করে সাজিয়ে তুলতে পারি না?

জমিদারি প্রথা হারিয়ে গেলেও জমিদারদের নির্মিত ইতিহাস মুছে যায়নি। শত বছরের পুরনো সাতানি জমিদার বাড়ি আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অটুট সাক্ষী হয়ে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা এখানে আসেন; ভবনের ভেতরে-বাইরে ছবি তোলেন, হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস হাতড়ে দেখা খুঁজে পান বাংলার অতীতকে। স্থানীয়রা মনে করেন—যদি এর সংস্কার করা হয়, তাহলে এটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বরিশাল পৌঁছে নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে বানারীপাড়া যেতে হয়। সন্ধ্যা নদীর খেয়া পার হলেই চোখে পড়ে সাতানি জমিদার বাড়ির পুরোনো দালানগুলোর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। ইতিহাস, স্মৃতি আর নিদর্শনের সমাহার এই বাড়ি এখনো অপেক্ষায় রয়েছে যারা ইতিহাসকে স্পর্শ করতে চান, যারা প্রাচীন বাংলার সাথে পরিচিত হতে চান—তাদের জন্য।

to join the global Sanatani Hindu Community
Connect with Sanatani Hindus from all over the world — share, learn, and grow together.
Explore Questions, Bhajan Lyrics, Leelas, Feeds, Business Pages, Products, plus Shlokas, Events, Courses, Jobs, Marriage, Help Posts, and more.
মন্তব্য করতে Login অথবা Registration করুন