
সিলেটে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মন্দির দখল ও তালা মারার অভিযোগ ! বন্ধ পূজা
HindusNews ডেস্ক :
সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারে অবস্থিত ঐতিহাসিক ও বহু ভক্তের আশ্রয়স্থল শ্রী শ্রী রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়া বর্তমানে তীব্র সংকটের মুখে। আখড়ার জমি ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বহুদিন ধরে চলা টানাপোড়েন নতুন করে বিস্ফোরিত হয়েছে সাম্প্রতিক দখলচেষ্টা, হামলা এবং মন্দিরে তালা দেওয়ার ঘটনার পর। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় পূজা-অর্চনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছে, আর এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনেও নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে—বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী এবং মহানগর বিএনপির সহসভাপতি ও সনাতনী নেতা সুদীপ রঞ্জন সেন বাপ্পু মন্দিরে গিয়ে তালা লাগিয়ে দেন, যার ফলে গত কয়েকদিন ধরে নিয়মিত পূজা সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত ২৩ নভেম্বর, যখন সুদীপ বাপ্পুর নেতৃত্বে কয়েকজন কর্মী মন্দিরে প্রবেশ করে তালা ভেঙে দখলের চেষ্টা চালায়। এসময় তারা মন্দিরের সেবায়েত জিতেন চন্দ্র নাথের স্ত্রী স্মৃতি রাণী নাথ ও পরিবারের সদস্যদের মারধর করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হামলায় তাদের ছেলে রাহুল দেবনাথ আহত হন। পরে হামলাকারীরা উল্টো ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধেই মামলা দিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলেন। পুলিশ প্রাথমিকভাবে ভুক্তভোগীদের মামলা না নিলে তারা আদালতের শরণাপন্ন হন এবং আদালতের নির্দেশে দ্রুত বিচার আইনে মামলা রুজু হয়।
ঘটনার পর বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী ঘটনাস্থলে গিয়ে দুই দিনের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস দিয়ে মন্দিরে তালা লাগিয়ে দেন। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও তালা খোলা হয়নি, বরং পূজা-অর্চনা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে ভক্তদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে মন্দিরের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলোর মধ্যে জমি আত্মসাৎ ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত। পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে—দীর্ঘদিন ধরে কথিত পরিচালনা কমিটির কয়েকজন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি জালিয়াতির মাধ্যমে আখড়ার প্রায় ১২ কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি ও ১২ কোটি ২৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এই ঘটনায় ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিটও দাখিল করা হয়েছে, যেখানে বিতর্কিত সনাতনী নেতা সুদীপ রঞ্জন সেন বাপ্পুর নামও রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—১৯৫৬ সালে আখড়ার তৎকালীন সম্পাদক বিরজা মোহন দাস পুরকায়স্থ নানা কারসাজির মাধ্যমে দেবোত্তর সম্পত্তি নিজের স্ত্রীর নামে রেকর্ড করেন। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে অবৈধ পরিচালনা কমিটি আখড়ার গুরুত্বপূর্ণ ১১.৪৪ শতাংশ জমি হস্তান্তর করে দেয়, যেখানে বর্তমানে বাণিজ্যিক ভবন দাঁড়িয়ে গেছে।
স্থানীয়দের দাবি—সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা নিতাই পাল দলীয় অবস্থান বদলে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন। অতীতে তিনিই প্রভাব খাটিয়ে মন্দিরের জায়গায় অবৈধ ভবন নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন, যা আদালতের আদেশে বন্ধ হয়। এখন পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা প্রদীপ ভট, তপন মিত্র ও শান্তনু দত্ত সন্তুকে সঙ্গে নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ।
হামলার শিকার পরিবারের সদস্য রাহুল দেবনাথ বলেন, “প্রশাসনিক তদন্তে এত বড় অঙ্কের আত্মসাতের প্রমাণ থাকার পরও সুদীপ বাপ্পুকে হিন্দু ধর্ম কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি করা কীভাবে সম্ভব? তিনি আমাদের পরিবারের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছেন, আর এখন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছেন।” তিনি আরও অভিযোগ করেন—গত আগস্টেও মন্দিরে তালা দেওয়া হয়, যা সেনাবাহিনী খুলে দেয়। এখন আবার নতুন করে তালাবদ্ধ করা হয়েছে।
অন্যদিকে নিতাই পাল অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, তিনি শুধু মন্দিরের জায়গার ভাড়াটিয়া, কোনো ভবন নির্মাণ বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। সুদীপ রঞ্জন সেন বাপ্পুও অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি করে বলেন, তারা আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সাধারণ সভা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু উল্টো বাধার মুখে পড়েন এবং হামলার শিকার হন।
আইনজীবীরা বলছেন—দেবোত্তর সম্পত্তি কোনোভাবেই ব্যক্তি পর্যায়ে ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য নয়, এবং পূজাস্থলে তালা দেওয়া সাম্প্রদায়িক উস্কানির শামিল। প্রশাসন চাইলে সেখানে নিরাপত্তা দিয়ে পূজা-অর্চনা অব্যাহত রাখতে পারে।
এসএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন—মন্দিরে তালা দেওয়ার বিষয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক জ্ঞান নেই, তবে উভয়পক্ষের মামলার তদন্ত চলছে।
এদিকে সাধারণ ভক্ত ও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় দ্রুত তালা খুলে পূজা-অর্চনা চালুর দাবি জানিয়েছে। তারা প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র ও ধর্ম উপদেষ্টার জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেছে—মন্দির নিয়ে চলমান বিশৃঙ্খলা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।