হাইব্রিডের বিরুদ্ধে লক্ষ্মীর লড়াই : দেশীয় বীজের রক্ষক খুলনার লক্ষ্মী রানী মণ্ডল

1 day ago
VIEWS: 39

HindusNews ডেস্ক :

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার ঝড়ভাঙ্গা গ্রামের লক্ষ্মী রানী মণ্ডল এখন দেশীয় বীজ সংরক্ষণের এক উজ্জ্বল প্রতীক। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে শাক-সবজি, শস্য, ফল ও ফুলগাছ মিলিয়ে ৩৬৮ প্রজাতির দেশি বীজ। হাইব্রিড বীজের দৌরাত্ম্যে যখন গ্রামবাংলায় দিন দিন কমে যাচ্ছে দেশীয় জাত, ঠিক তখনই নিজের চেষ্টায় একা লড়াই করে যাচ্ছেন লক্ষ্মী। উঠানের সামান্য জমি, পুকুরপাড়, বাড়ির চারপাশের টুকরো জায়গা—সবখানেই তিনি মৌসুমভিত্তিক সবজি ফলান, বীজ সংগ্রহ করেন এবং তা সংরক্ষণ করেন। শুধু নিজের প্রয়োজনই নয়, আশপাশের গ্রামের নারীদেরও শেখাচ্ছেন কীভাবে বীজ সংরক্ষণ করতে হয়।

লক্ষ্মীর এই যাত্রা শুরু হয় অভাব থেকেই। খুলনার পাইকগাছার কপিলমুনিতে জন্ম তাঁর। মায়ের অসুস্থতায় ছোটবেলাতেই শিক্ষাজীবন থেমে যায়। অল্প বয়সে বিয়ে, এরপর স্বামীর বাড়িতেও অভাবের টানাপোড়েন। সবজি কিনতে পারা কিংবা সবসময় স্বামীর ওপর নির্ভরশীল হওয়া তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলত। বাবার বাড়িতে মা-দিদিদের বীজ সংরক্ষণের অভ্যাস দেখেই তাঁর মনে বীজের গুরুত্বটি গেঁথে ছিল। সেই স্মৃতি থেকেই শুরু হয় তাঁর কৃষিযাত্রা। বসতভিটার চারপাশে সবজি লাগানো, দেড় বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ—ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন, দেশীয় বীজই হতে পারে তাঁর আত্মনির্ভরতার পথ।

আজ তাঁর বাড়ির ড্রাম, টিনের পাত্র আর কৌটা ভর্তি বীজের ভাণ্ডার। সব বীজই স্থানীয় প্রজাতির। তিনি সেগুলো রোদে শুকিয়ে আর্দ্রতামুক্ত পাত্রে ভরে রাখেন। মাসে একবার আবার রোদে দিয়ে সেগুলো সতেজ করেন। শিমের ১০ জাত, আলুর ১০ জাত, কলার ৮ জাত, বেগুন, মরিচ, লাউ, কুমড়ার বিভিন্ন জাত, ২০ জাতের ধান, ১৫ জাতের শাক, ১৫ জাতের ডালের মতো অসংখ্য প্রজাতি তিনি নিজ হাতে আগলে রাখেন। দেশজুড়ে অনেক মানুষ এখন তাঁর বাড়িতে আসে বীজ নিতে। পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ তাঁর চাষাবাদ দেখতেও আসেন।

লক্ষ্মীর অভিযোগ, হাইব্রিড কৃষিকে কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল করে তুলছে। প্রতি মৌসুমে বীজ কিনতে হয়, আবার সেই বীজ থেকে উৎপাদিত গাছ টেকে না, রাসায়নিক সার ও বিষ ছাড়া ফলনও আসে না। তাঁর বিশ্বাস, আমাদের নানা রোগবালাইয়ের পেছনেও এসব বিষাক্ত উপকরণের বড় ভূমিকা রয়েছে। অন্যদিকে দেশীয় জাতের বীজ বহু বছর টেকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরেও আবার লাগানো যায়, সার-কীটনাশকও কম লাগে। বাড়িতে সারা বছর শাক-সবজি থাকার কারণে তাঁর বাজার নির্ভরতা প্রায় নেই বললেই চলে।

দেশীয় বীজ সংরক্ষণে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিও মিলেছে বারবার। বেসরকারি সংস্থা ‘লোকজ’-এর বীজমেলাগুলোতে তিনি বহুবার প্রথম হয়েছেন। এ বছর হয়েছেন তৃতীয়। ২০১৭ সালে পেয়েছেন উপজেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কৃষাণি সম্মাননা। তাঁর সাফল্যে আশেপাশের নারীরাও উদ্বুদ্ধ হয়ে বীজ সংরক্ষণে মন দিচ্ছেন। ফলে এলাকায় সবজির চাহিদা যেমন মিটছে, তেমনি অতিরিক্ত সবজি বিক্রি করে নারীরা আয়ও করছেন।

তবে বয়সের কারণে আজ আর আগের মতো শক্তি পান না লক্ষ্মী। প্রতিদিন চাষের জমিতে পানি দিতে কাঁখে করে জল আনা তাঁর জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। তাই তাঁর একটাই অনুরোধ—যদি কেউ একটি পানি তোলার পাম্প স্থাপনে সাহায্য করত, তাহলে তাঁর পরিশ্রম অনেকটাই কমে যেত।

দেশীয় বীজ রক্ষার এই সংগ্রামে লক্ষ্মী রানী মণ্ডল এখন শুধু একজন নারী কৃষক নন; তিনি গ্রামীণ জৈব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে এক অনন্য যোদ্ধা। তাঁর প্রচেষ্টা জাগিয়ে তুলছে আশার আলো—যে দেশীয় বীজের ঐতিহ্য এখনো বেঁচে আছে, এবং বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, যদি থাকে একটিবারের ইচ্ছাশক্তি।

to join the global Sanatani Hindu Community
Connect with Sanatani Hindus from all over the world — share, learn, and grow together.
Explore Questions, Bhajan Lyrics, Leelas, Feeds, Business Pages, Products, plus Shlokas, Events, Courses, Jobs, Marriage, Help Posts, and more.
মন্তব্য করতে Login অথবা Registration করুন