
রাধা মনি দাস: ১৩০০ টাকা নিয়ে অচেনা চট্টগ্রামে বেঁচে থাকার সংগ্রাম
HindusNews ডেস্ক :
সবাই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না—এই প্রচলিত কথার বাস্তব রূপ যেন রাধা মনি দাস। নরসিংদীর সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এই মেয়েটির পথচলা শুধুই সংগ্রামের, কিন্তু হাল না ছাড়া ইচ্ছাশক্তির উজ্জ্বল প্রতীকও বটে। পড়াশোনার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে চট্টগ্রামে পা রেখেছিলেন তিনি মাত্র ১৩০০ টাকা পকেটে নিয়ে। সেই পথ কখনো সহজ ছিল না। তবু রাধা মনি দাস প্রমাণ করে দিয়েছেন—দারিদ্র্য যতই তাড়া করুক, স্বপ্নকে থামানো যায় না।
করোনার পর রাধার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। বাবার ছোট্ট জুতার দোকানটি বিক্রি করে দিতে হয়, শুরু হয় ঋণ আর কিস্তির নিরন্তর চাপ। ঘরের দরজায় কিস্তিওয়ালাদের আগমন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এমনই হতাশার ভেতরেও রাধার পড়াশোনার প্রতি আশা হারাননি তাঁর দাদা। পরিবারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে তিনি সিএনজি চালানো শুরু করেন—শুধুই বোনের মেয়ের পড়ার খরচ চালিয়ে নেওয়ার জন্য।
সমাজের কটু চোখ, প্রতিবেশীদের কটাক্ষ—সবকিছুকে উপেক্ষা করেই দাদা রাধাকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ানোর সংকল্প ধরে রেখেছিলেন। একসময় উন্নত জীবনের আশায় বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সেজন্য বিক্রি করে দেন নিজের সিএনজি, ধারকর্জে জোগাড় করেন অঢেল টাকা—কিন্তু শেষপর্যন্ত সবটাই প্রতারণার জালে হারিয়ে যায়। বিদেশযাত্রা তো দূরের কথা, পরিবার আরও গভীর সংকটে পড়ে।
এরপর রাধার পড়াশোনা প্রায় থমকে যাওয়ার উপক্রম। মনে হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার স্বপ্ন এখানেই শেষ। কিন্তু ভাগ্য কখনোই পরিশ্রমী মানুষকে একেবারে নিরাশ করে না। রাধা আবেদন করেন আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ বৃত্তির জন্য। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবার থেকে প্রথম মেয়েসন্তান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানো শিক্ষার্থীদের জন্য এই বৃত্তি যেন আশার আলো। রাধা সেই আলোই পেলেন—নিরবচ্ছিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও হয়ে উঠলেন বৃত্তিপ্রাপ্তদের একজন।
চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে ভর্তি হওয়ার জন্য যখন তাঁকে প্লেসমেন্ট টেস্ট দিতে যেতে হলো, তখন দেশে শুরু হয়ে গেছে ভয়াবহ বন্যা। ঢাকার রাস্তাঘাট ভেঙে পড়েছে, চট্টগ্রামগামী কোনো বাস যাত্রা করতে পারছে না। সুযোগ হারানোর ভয়, আর অসম্ভব পরিস্থিতির মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হলো—যেতেই হবে, যেভাবেই হোক। মাসতুতো বোনের কাছ থেকে তিন হাজার আর বড় বোনের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা ধার করে বিমানের টিকিট কাটলেন তিনি। পাশে কেউ নেই, বাবাও আসতে পারেননি টিকিটের কারণে। ১৩০০ টাকা পকেটে নিয়ে একা চট্টগ্রামে নেমে শুরু করলেন তাঁর নতুন জীবন।
এরপর শুরু হয় আরেক পর্যায়ের সংগ্রাম। ভাড়ার টাকা না থাকায় টানা আট মাস বাড়িতে যেতে পারেননি। সেই সময়ে জেঠুর মৃত্যুসংবাদ পেলেও ছুটে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না রাধার। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে শেষবার দেখতে না পারার ব্যথা বুকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে।
বর্তমানে রাধা মনি দাস এইউডব্লিউ-তে প্রি আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়ে পড়ছেন। ‘অদ্বিতীয়া’ বৃত্তি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সহায় হয়ে উঠেছে—টিউশন ফি মওকুফ, আবাসনের সুযোগ আর নিয়মিত সহায়তা তাঁকে নতুন করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জুগিয়েছে। তাঁর মতো আরও অনেক মেয়েকে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয় এই বিশেষ বৃত্তি।
কঠিন পথ পেরিয়ে যাওয়া রাধা আজও থামেননি—বরং এগিয়ে চলেছেন ভবিষ্যতের পথে। তাঁর স্বপ্ন, নিজের মতো সংগ্রামী আরও অনেক মেয়েকে শিক্ষিত করে সমাজে আলোর পথ দেখানো।