
স্বভাবগত ভুলেই ঘনীভূত হচ্ছে হিন্দু সমাজের সংকট: অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণেই পিছিয়ে পড়া বাড়ছে
HindusNews ডেস্ক :
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নানা সময় বিভিন্ন ধরনের অন্যায়, নির্যাতন, বৈষম্য ও রাজনৈতিক অবহেলার অভিযোগ নতুন নয়। তবে এ ধরনের সংকটগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সাধারণত দোষারোপ করা হয় বিপরীত ধর্ম, রাজনৈতিক শক্তি বা রাষ্ট্রযন্ত্রকে। কিন্তু অনেক গবেষক, বিশ্লেষক ও সনাতনী সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা মনে করেন—সমস্যার একটি বড় অংশ তৈরি হয় সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরেই। স্বভাবগত কিছু দুর্বলতা, দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক অচেতনতা, ভয়, উদাসীনতা ও সংগঠিত না হওয়ার প্রবণতা আজ হিন্দু সমাজকে আরও অসহায় করে তুলছে।
ধর্মীয় নিপীড়ন, জমি-সম্পত্তি দখল, গুজব ছড়িয়ে হামলা, রাজনৈতিকভাবে উপেক্ষা কিংবা সামাজিক বৈষম্যের পরিস্থিতিতে হিন্দু সমাজ নিজেকে প্রায়ই দুর্বল অবস্থায় খুঁজে পায়। বিশ্লেষকদের মতে, এর নেপথ্যে শুধু বাহ্যিক শক্তিই নয়, বরং নিজের ভিতরকার একটি মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোও কাজ করে। বছরের পর বছর ধরে হিন্দু সমাজে এমন কিছু আচরণ গড়ে উঠেছে, যা সংকটের সময় সাহস, ঐক্য, রাজনৈতিক ভূমিকা কিংবা সংগঠিত প্রতিরোধের জায়গায় বাধা সৃষ্টি করে।
রাজনৈতিক অনীহা এদের মধ্যে অন্যতম। রাজনৈতিক প্রশ্নে হিন্দুদের মধ্যে যেন এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায়। রাজনীতি বোঝার চেষ্টা না করা, অংশগ্রহণে অনীহা এবং “ঝামেলা এড়িয়ে চলা” মানসিকতা তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে প্রায় অদৃশ্য করে রেখেছে। ফলে জাতীয় সিদ্ধান্ত, নীতি নির্ধারণ কিংবা অধিকার সংক্রান্ত আলোচনায় তাদের উপস্থিতি দুর্বল থাকে। রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে অন্যরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এবং হিন্দুদের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
একই সঙ্গে রয়েছে অতিরিক্ত ভদ্রতা, অতিরিক্ত সহিষ্ণুতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করার অভ্যাস। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, চুপ থাকা অপরাধীদের আরও শক্তি দেয়। যখন একটি সম্প্রদায় নিজস্ব অধিকার রক্ষায় প্রতিবাদী হয়ে ওঠে না, তখন আক্রমণকারীদের চোখে তারা আরও দুর্বল হিসেবে দেখা দেয়। এ ধরনের নীরবতা জমিজমা দখল, হামলা, লুটপাট, ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি, সামাজিক বৈষম্যসহ নানা প্রতিকূল অবস্থার পথ আরও সহজ করে দেয়।
হিন্দু সমাজের আরেকটি বড় সমস্যা সংগঠিত না হওয়া। ঐক্যের অভাব, পারস্পরিক সমর্থনের সংকট এবং অভ্যন্তরীণ বিভক্তি বারবারই প্রমাণ করে যে হিন্দুরা নিজেদের স্বার্থে নিজস্ব লোকজনকে পাশে দাঁড় করাতে পারে না। বরং দেখা যায়—যে ব্যক্তি সত্য কথা বলে, বা মাঠে কাজ করে, তাকে সমর্থন না দিয়ে অনেকে সমালোচনা করেন, হিংসা করেন কিংবা তাকে নিরুৎসাহিত করেন। নিজেদের মাঝেই বিভক্তি তৈরি হওয়ার ফলে সম্প্রদায়ের সম্মিলিত শক্তি ভেঙে পড়ে, আর অত্যাচারের সময় পাশে দাঁড়ানোর মতো কাঠামো গড়ে ওঠে না।
এ সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জানার অনাগ্রহ। অধিকার, আইন, নিরাপত্তা, রাজনীতি বা নিজেদের ধর্ম-বানির প্রকৃত জ্ঞান—এসব বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু সমাজে সচেতনতার অভাব দেখা যায়। ফলে নানা গুজব, মিথ্যাচার, ধর্মান্তরের কৌশল, প্রতারণা এবং উসকানি সহজেই প্রভাব ফেলে। অসচেতনতা মানুষের মনকে দুর্বল করে দেয়, আর দুর্বল সমাজ আক্রমণের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়তে পারে না।
এ সংকট সোশ্যাল মিডিয়াতেও স্পষ্ট। যেখানে সচেতনতা গড়ে তোলা, অধিকার আদায়ের আলোচনা করা এবং গুজবের মোকাবিলা হওয়া উচিত ছিল, সেখানে অধিকাংশই ব্যস্ত থাকে বিনোদন, নৃত্যের ভিডিও, দেবদেবীর ছবি, সেলফি বা হালকা ধরণের কনটেন্টে। অধিকার বা নির্যাতন নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক গ্রুপেই বাধা আসে—“রাজনীতি চাই না”, “সংবেদনশীল বিষয়”, কিংবা “ঝামেলা বাড়বে” ধরনের অজুহাতে সত্য কথা থামিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সমাজ অন্ধকারেই থেকে যায়।
সমালোচনার প্রবণতাও একটি বড় সমস্যা। মাঠে কাজ করা কিছু লোককে সমর্থন না দিয়ে বরং সমালোচনা করা, হিংসাপূর্ণ আচরণ করা কিংবা বিভক্তি তৈরি করা হিন্দু সমাজকে আরও দুর্বল করে। অনেকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নীরব থাকেন, আবার নিরাপদ হলে পরবর্তীতে কথা বলেন। এই দ্বিচারিতা সমাজের ভেতর আরও অবিশ্বাস তৈরি করে।
সব মিলিয়ে ফলাফল হয় একটাই—পরিবর্তন ঘটে না। সংকট থেকেই যায়, বরং আরও বেড়ে ওঠে। বিশ্লেষকদের মতে, প্রয়োজন এখন একটাই—নিজেদের স্বভাবগত দুর্বলতাকে চিহ্নিত করা এবং এগুলো পরিবর্তনের চেষ্টা করা। বাহ্যিক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার আগে হিন্দু সমাজকে নিজেদের ভেতরের ভয়ের সংস্কৃতি, অসচেতনতা, অহেতুক ভদ্রতা, উদাসীনতা ও বিভক্তিকে পরাজিত করতে হবে।
একই সঙ্গে দরকার রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়া, সামষ্টিকভাবে সংগঠিত হওয়া, প্রতিবাদী কণ্ঠ গড়ে তোলা এবং সত্যকে বলার সাহস তৈরি করা। শুধু দেবতার ওপর ভরসা করে অথবা “কেউ এসে বাঁচাবে” এই মানসিকতা ধরে রেখে কোনো সম্প্রদায় টিকে থাকতে পারে না। পরিবর্তন চাইলে প্রথমেই পরিবর্তন আসতে হবে নিজের মধ্যেই।
হিন্দু সমাজের অনেকেই বলছেন—প্রতিকূলতা যতই বড় হোক, নীরবতা নয়; সচেতনতা, ঐক্য, প্রতিবাদী মনোভাব এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তাই পারে ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করতে। না হলে এই সমাজ আরও দুর্বল হবে, অধিকার হারাবে, ভয় ও বিভক্তির চক্রে আটকে পড়বে এবং দেশান্তর হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি গড়াতে থাকবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়—হিন্দু সমাজ কি নীরবতার পথেই থাকবে, নাকি নিজেরা বদলে, সংগঠিত হয়ে, সচেতন হয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করার চেষ্টা করবে।