
বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে সংখ্যালঘু নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করল HRCBM
HindusNews ডেস্ক :
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ২০২৫। “সুরক্ষিত হোক মানুষের অধিকার এবং শান্তিতে বসবাস করুক প্রতিটি নাগরিক”—এই বার্তা ধারণ করে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা Human Rights Congress for Bangladesh Minorities (HRCBM) বাংলাদেশ ন্যাশনাল চ্যাপ্টার আজ সকালে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। রাজধানীর বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) ভবনের নিচতলায় অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সংস্থার কনভেনর অ্যাডভোকেট লাকী বাছাড়। তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আশীষ কুমার অঞ্জন, অ্যাডভোকেট জিতেন্দ্র চন্দ্র বর্মন, অনিল পাল, রিপন দাস, বিমল কান্তি চাকমা, জীবন কুমার, রাজ চাকমা, রঞ্জন সরকার, অমিত বর্মন, বিমলেন্দু দাস ও ইতিমা মণ্ডলসহ HRCBM-এর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই অ্যাডভোকেট লাকী বাছাড় মানবাধিকার দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন, মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (UDHR) ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর গৃহীত হওয়ার পর থেকেই এই দিনটি বিশ্বব্যাপী মানবিক মর্যাদা, সমতা ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে পালন করা হচ্ছে। তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী—বিশেষত সংখ্যালঘু, নারী, শিশু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় HRCBM দুই দশকের বেশি সময় ধরে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। সংস্থাটি জাতিসংঘের ECOSOC-এর বিশেষ পরামর্শক মর্যাদা লাভ করেছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC)-এর এনজিও জোটের সদস্য হিসেবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু অধিকার ইস্যু তুলে ধরছে।
লাকী বাছাড় বলেন, ২০২৫ সাল বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক একটি বছর। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন সংখ্যালঘু নাগরিক হত্যার শিকার হয়েছেন অথবা রহস্যজনকভাবে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছেন। শুধু ডিসেম্বরের প্রথম নয় দিনেই ছয়জন সংখ্যালঘু নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। মাঠপর্যায়ের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংগৃহীত এই তথ্য এখনও পূর্ণাঙ্গ নয়; চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করা হলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রতিক ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড নিয়েও তীব্র নিন্দা জানায় HRCBM। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার উত্তর রাহিমাপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক প্রধান শিক্ষক যোগেশ চন্দ্র রায় (৭৫) এবং তাঁর স্ত্রী সুবর্ণা রায় (৬০)-কে নিজ বাড়িতে নৃশংসভাবে হত্যা। নিহতের ছেলে সোভেন চন্দ্র জানিয়েছেন, শ্মশানের জমি দানকে কেন্দ্র করেই এ ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এর আগে নরসিংদীর রায়পুরায় স্বর্ণকার প্রান্তোষ সরকারকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। মাদারীপুরে মাছ ব্যবসায়ী উৎপল সরকার দুর্বৃত্তদের হামলায় প্রাণ হারান। গোপালগঞ্জে আবির সাহার মরদেহ বাগান থেকে উদ্ধার করা হয় এবং বান্দরবনের রুমায় লালরাম সং বমের লাশ জঙ্গলে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এসব হত্যাকাণ্ড কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, দেশের সংবিধান এবং সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, লুটপাট, বাড়িঘর পোড়ানো, নারী ও শিশুর ওপর যৌন সহিংসতা, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হেনস্তা, মিথ্যা মামলা, জবরদখল ও জোরপূর্বক উচ্ছেদ, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি দখল এবং টার্গেট কিলিং—এসব অপরাধের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলেও জানায় HRCBM। সংগঠনটি অভিযোগ করে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ঘটনার সঠিক তদন্ত হয় না, দোষীদের আইনের আওতায় আনা হয় না এবং ভুক্তভোগীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এতে সংখ্যালঘুদের সামাজিক অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতিও চরম সংকটে পড়ছে।
সংবাদ সম্মেলনে HRCBM সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় যাতে প্রতিটি সহিংসতার ঘটনায় দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা হয় এবং বিশেষ করে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ধর্মীয় উসকানি ও মব ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে কঠোর শূন্য সহনশীল নীতি প্রণয়ন, ভুক্তভোগী পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও নিরাপত্তা প্রদান এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করারও আহ্বান জানানো হয়।
শেষ বক্তব্যে অ্যাডভোকেট লাকী বাছাড় বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র, সমাজ এবং ব্যক্তি—সবার দায়িত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, “সংখ্যালঘুদের ওপর একের পর এক হামলা ও হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে এখনই কঠোর অবস্থান প্রয়োজন। মানবাধিকার কেবল একটি অধিকার নয়, এটি মানবিকতার ভিত্তি। মানবতা জিতুক, সহমর্মিতা জাগুক।”
HRCBM আগামী দিনেও বাংলাদেশের নির্যাতিত সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি জানায়।