
ফুলন দেবী: দস্যুরানী থেকে ভারতের সংসদ সদস্য,এক সংগ্রামী নারীর জীবনকথা
HindusNews বিশেষ প্রতিবেদন :
ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ফুলন দেবীর নাম উচ্চারণ হলেই মানুষের মনে ভেসে ওঠে এক নারী যিনি দুঃসহ নির্যাতন, দারিদ্র্য, বর্ণবিভেদ ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে উঠে এসে কখনো ‘দস্যুরানী’, কখনো ‘দস্যু সুন্দরী’, আবার কখনো একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। তার জীবনযাত্রা ছিল নাটকীয়, নির্মম, প্রতিশোধে ভরা, আবার ক্ষমা ও মানবিকতা দিয়ে গড়া বিস্ময়কর এক পথচলা।
আশির দশকে ভারতের আশেপাশের এলাকায় ফুলন দেবীর নাম বলিউডের কুখ্যাত চরিত্র গব্বর সিংকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নারীরা অনাচারে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলতেন, “ফুলনের মতো আচরণ করবো।” তার কঠোর হৃদয়ের কথা বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। বেহমাই গ্রামে ২২ জন উচ্চবর্ণ হিন্দু পুরুষকে গুলি করে হত্যার পরও কোন অনুশোচনা প্রকাশ করেননি তিনি। তবে বিতর্কের মধ্যে ছিল তার সরাসরি সম্পৃক্ততা।
ফুলন দেবী জন্মেছিলেন ১৯৬৩ সালে উত্তর প্রদেশের নিম্নবর্ণ হিন্দু পরিবারে। একাদশ শ্রেণীতে পৌঁছার আগেই চাচাদের চাপে তাকে ত্রিশোর্ধ্ব পুতিলালের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। স্বামীর বাড়িতে নিত্যদিন শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও সামাজিক চাপ তাকে বারবার স্বামীর বাড়িতে ফেরত পাঠাত। ১৯৭৯ সালে পারিবারিক জমি-বিবাদের জেরে থানায় আটক হওয়া, সেখানে মারধরের শিকার হওয়া তার জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে।
শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়ে তাকে বাবু গুজ্জরের ডাকাত দলের হাতে অপহরণ করা হয়। তিন দিন ধরে তাকে ধর্ষণ করা হয়। বিক্রম মাল্লা নামের দলের এক সদস্য বাবু গুজ্জরকে হত্যা করে দলটির নেতৃত্ব নেন এবং ফুলনকে অস্ত্র চালানো শেখান। এরপর ফুলন দেবী দলকে নেতৃত্ব দিয়ে উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় ত্রাস সৃষ্টিকারী ডাকাতি পরিচালনা করেন। নিম্নবর্ণের দরিদ্র হিন্দুদের কাছে তিনি তখন ‘দস্যু সুন্দরী’ নামে পরিচিত হন।
বিক্রম মাল্লার মৃত্যু ও তারপরে শ্রীরামের অপহরণের পর বেহমাই গ্রামে তিন সপ্তাহ ধরে ফুলন দেবীকে গণধর্ষণ করা হয়। গ্রামবাসীর সামনে নগ্ন অবস্থায় কুয়া থেকে পানি আনতে বাধ্য করা হয়েছিল তাকে। এই নির্মম নির্যাতন তাকে চিরকালীন ক্রোধ ও প্রতিশোধের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলে। ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দল নিয়ে বেহমাই ফেরার সময় উচ্চবর্ণদের ২২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যদিও তার সরাসরি সম্পৃক্ততা নিয়ে বিতর্ক ছিল, তবু অধিকাংশ বর্ণনাই তাকে ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করেছে।
বেহমাই হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরতে ব্যর্থ হলে আত্মসমর্পণের জন্য মধ্যপ্রদেশের এসপি রাজেন্দ্র চতুর্বেদির মাধ্যমে আলোচনার চেষ্টা করা হয়। ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে চতুর্বেদি তাকে দেখা করতে যান। অস্ত্রধারী, ক্রুদ্ধ ফুলন দেবী তার পায়ের কাছে ৫০১ টাকা রেখে বলেন, “আমি এখনই আপনাকে গুলি করতে পারি।” ধীরে ধীরে আলোচনার মধ্য দিয়ে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। ভিন্ডের স্টেজে গান্ধীর ছবিতে প্রণাম করে নিজের রাইফেল মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংয়ের পায়ের কাছে রাখার দৃশ্য ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
তিনি ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। ১৯৯৪ সালে সব মামলা প্রত্যাহার করা হলে মুক্তি পান। মুক্তির পর তাকে সমাজবাদী পার্টি লোকসভা নির্বাচনের টিকিট দেয় এবং ১৯৯৬ সালে মধ্যপ্রদেশ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন।
সাংসদ থাকা অবস্থায় ২০০১ সালের ২৫ জুলাই দিল্লির বাসভবনের সামনে শের সিং রানা নামে এক যুবক তাকে গুলি করে হত্যা করেন। দিনটি ছিল নাগ পঞ্চমীর দিন। ফুলন নিজের হাতে তৈরি ক্ষীর খাইয়ে সংসদে যান, ফেরার সময় গাড়ি থেকে নামার মুহূর্তে শের সিং তার ওপর গুলি চালায়। নয়টি গুলি লাগে তার শরীরে, দুইটি তার দেহরক্ষীর গায়ে। দুই দিনের মধ্যেই আততায়ী গ্রেফতার হলেও ২০০৪ সালে আদালতে আনার সময় পালিয়ে যান এবং ২০০৬ সালে আবার ধরা পড়েন। ২০১৪ সালে হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলেও ২০১৬ সালে জামিনে মুক্তি পান।
ফুলন দেবীর জীবন এক নারীর সংগ্রামের প্রতীক। নিম্নবর্ণের দরিদ্র মেয়েটি যে নিজ শক্তিতে ভারতের সংসদ পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন, তা আজও কোটি মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা। এক অমানবিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে তার লড়াই ও সাহস ইতিহাসে অমর হয়ে রইবে।