
রাজাকারমুক্ত হিন্দু সম্প্রদায়: ১৯৭১ থেকে আজও অব্যাহত অস্তিত্বের লড়াই
ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর মুক্তমত,HindusNews ডেস্ক :
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায় ছিল সম্পূর্ণ রাজাকারমুক্ত—এমন ঐতিহাসিক সত্য নতুন করে সামনে এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক গুরুত্বপূর্ণ মুক্তমত পোস্টে। “১৯৭১ সালে হিন্দু সম্প্রদায় ছিল রাজাকারমুক্ত এবং সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ও বাস্তুচ্যুতির শিকার” শীর্ষক লেখাটি প্রকাশের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
লেখক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তী তাঁর লেখায় দাবি করেন, একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ই ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান টার্গেট। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটে এবং প্রায় এক কোটির কাছাকাছি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়—যাদের প্রায় ৯২ শতাংশই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
ভারতের তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য উদ্ধৃত করে লেখক জানান, ১৯৭১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ভারতে প্রবেশ করা শরণার্থীদের মধ্যে মাত্র ৭.২ শতাংশ ছিল অহিন্দু, বাকি সবাই হিন্দু। ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৯২ লাখে। এর পেছনে মূল কারণ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পিতভাবে হিন্দু নিধন।
লেখায় চুকনগর গণহত্যাসহ বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় সংঘটিত গণহত্যার উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়, “পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার তালিকায় প্রথমেই ছিল হিন্দু—এরপর অন্যরা।”
ড. চক্রবর্তী আরও বলেন, স্বাধীনতার পরও হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্ভোগ শেষ হয়নি। ২০০১ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, মন্দির ভাঙচুর, বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার ঘটনা ঘটেছে। অথচ এসব ঘটনায় বিচারহীনতা আজও সংখ্যালঘুদের মনে গভীর উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা তৈরি করে রেখেছে।
বিশেষ করে ২০২১ সালের দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী, বান্দরবান ও রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত সহিংসতার কথা উল্লেখ করে লেখক বলেন, পরিকল্পিতভাবে শত শত মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয় এবং বহু হিন্দু পরিবার সর্বস্ব হারায়। এসব ঘটনায় একাধিক মানুষের প্রাণহানিও ঘটে।
লেখায় ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের গভীর দেশপ্রেমের দিকটি তুলে ধরা হয়। অথর্ববেদ ও রামায়ণের শ্লোক উল্লেখ করে বলা হয়—সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে জন্মভূমি ও মাতৃভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। তাই বারবার নির্যাতিত হলেও এ দেশকেই তারা নিজেদের চিরস্থায়ী আবাস বলে মনে করে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—একবুক রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরও যদি একবিংশ শতাব্দীতে এসে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় থাকে, তবে রাষ্ট্রের দায় কোথায়?
ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর মতে, এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো সংখ্যালঘুদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্রিয় ভূমিকা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ না হলে সংখ্যালঘুদের আস্থা ফিরবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
লেখার শেষাংশে ১৯৭১ সালের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে লেখক বলেন, সেই দিনই হবে বিজয় দিবসের প্রকৃত প্রাপ্তি—যেদিন এ দেশের প্রতিটি নাগরিক, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশাবাদী কণ্ঠে লেখাটি শেষ করেন তিনি—নতুন সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায়, যেখানে এ দেশ সত্যিকার অর্থেই সকলের মাতৃভূমি হয়ে উঠবে।