
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে: HRCBM-এর জাতীয় সম্মেলনে উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ
ঢাকা প্রতিনিধি :
বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটিজ (HRCBM)।
শুক্রবার ঢাকায় আয়োজিত সংস্থাটির জাতীয় সম্মেলনে বক্তারা বলেন, সংখ্যালঘু নির্যাতন এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি একটি কাঠামোগত মানবাধিকার সংকটে রূপ নিয়েছে, যেখানে দায়মুক্তির সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অপব্যবহার ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা একসঙ্গে কাজ করছে।
সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন HRCBM-এর কনভেনর অ্যাডভোকেট লাকী বাছাড়। তিনি বলেন, HRCBM একটি অধিকারভিত্তিক, অরাজনৈতিক ও স্বতন্ত্র মানবাধিকার সংস্থা, যা জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ECOSOC)-এর বিশেষ পরামর্শক মর্যাদাপ্রাপ্ত এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) এনজিও কোয়ালিশনের সদস্য। সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক সম্প্রীতি জোরদারে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি জানান, HRCBM মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, গণমাধ্যম যাচাই এবং আইনি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো নিয়মিতভাবে নথিভুক্ত করছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে সংস্থাটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার অ্যাডভোকেসি চালিয়ে আসছে এবং ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা প্রদান করছে।
সম্মেলনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১৭ দিনে সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত অন্তত ৫৪টি নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে HRCBM। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে হত্যা, রহস্যজনক মৃত্যু, হত্যাচেষ্টা, হামলা, জমি দখল, মন্দির ও শ্মশানঘাট দখল, জোরপূর্বক ফসল কেটে নেওয়া, নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণ এবং ধর্মীয় সংবেদনশীলতা লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অপরাধ।
সংস্থাটির তথ্যমতে, ডিসেম্বর ২০২৫-এর প্রথম ১৭ দিনে সারা দেশে মোট ১৩০টি হত্যা বা রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে অন্তত ১৬ জন ছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১০৪ জন সংখ্যালঘু ব্যক্তি হত্যা বা রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছে HRCBM।
অ্যাডভোকেট লাকী বাছাড় বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব ঘটনা ভাইরাল হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে প্রশাসন তৎপরতা দেখালেও বহু ঘটনা নীরবে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ভাইরাল না হওয়া ঘটনায় অপরাধী শনাক্ত, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া চরমভাবে ধীর হয়ে যায়, যা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার স্পষ্ট প্রমাণ।
HRCBM-এর ২০২৫ সালের প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্যে আরও উঠে এসেছে, চলতি বছরে সংখ্যালঘু হত্যা বা রহস্যজনক মৃত্যুর সংখ্যা ১০৩ জনে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৭৪ জন। নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র আরও ভয়াবহ; নিখোঁজ, ধর্মান্তর, নির্যাতন, যৌন সহিংসতা ও অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৪৮ জন সংখ্যালঘু নারী। শুধু যশোর জেলাতেই ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ২২৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ১৩৬ জনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বলে দাবি করা হয়।
সম্মেলনে বক্তারা বলেন, এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়; এগুলো ভাঙা পরিবার, ধ্বংসপ্রাপ্ত জীবন এবং রাষ্ট্রীয় অবহেলার দলিল। তারা জোর দিয়ে বলেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনকে রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে নয়, একটি গুরুতর মানবাধিকার সংকট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
এই প্রেক্ষাপটে HRCBM বাংলাদেশে একটি মানবাধিকারভিত্তিক ট্রানজিশনাল জাস্টিস কাঠামো গড়ে তোলার দাবি জানায়। বক্তারা বলেন, সত্য উদঘাটন, নিরপেক্ষ তদন্ত, ভুক্তভোগীদের স্বীকৃতি ও প্রতিকার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং ভবিষ্যতে এমন অপরাধ পুনরাবৃত্তি রোধে ট্রানজিশনাল জাস্টিস বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
সম্মেলনে উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট ড. জে. কে. পাল, যিনি সভায় সভাপতিত্ব করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোর্শেদ, ড. মোহাম্মদ আব্দুল হাই এবং শিউলি শর্মা। বক্তারা সবাই সংখ্যালঘু সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সম্মেলনের শেষাংশে HRCBM-এর পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২৫ সালের পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০২৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশ করা হবে। সেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের সামগ্রিক চিত্র, দায়ীদের ভূমিকা এবং করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ থাকবে।
বক্তব্যের সমাপ্তিতে অ্যাডভোকেট লাকী বাছাড় বলেন, “ন্যায়বিচার দেরিতে হলেও অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্র যদি নীরব থাকে, সত্য ইতিহাস হয়ে সাক্ষ্য দেয়। মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সংখ্যালঘু সুরক্ষার পক্ষে আমাদের সবাইকে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে।”